মুসলিম এক্টিভিস্টদের মাঝে নারীবাদের বিষ : মাতৃত্বের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ

আধুনিক সময়ের অনেক কমবয়সী নারী ক্যারিয়ার আর বিয়ের মধ্যে কোনটাকে প্রাধান্য দিবে তা নিয়ে সন্দিহান ৷ তারা দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তারপর এ ব্যাপারে অমুসলিমদের অনুসরণ করে নিজেদেরই ধ্বংস ডেকে আনে।

আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ তো এমন আছে যারা তোতাপাখির মতো নারীবাদের বুলি শয়নে স্বপনে আওড়ায়, এরপর যখন নিজেদের ক্ষতি উপলব্ধি করে এবং একদম নি:স্ব হয়ে যায়, তখন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে “কীরে! আমার এমন দশা কিভাবে হলো?” অনেকে আবার মুসলিম পুরুষদের দোষ দেয় যে তারা কেন চাকরিজীবী নারী বিয়ে করতে চায়না। কেন তারা “ক্যারিয়ারিস্ট”, “স্বাধীন”, “ক্ষমতাবান” নারীদের সহ্য করতে পারেনা! পুরুষদের হীনমন্যতা নিয়ে তখন প্রশ্ন করা হয়! শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাকে বলে।

এমন শোচনীয় অবস্থার একটা গতি হওয়া দরকার ৷ বিশেষ করে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন মুসলিম নারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে যারা এই ব্যাপারে জল আরো ঘোলা করছে ৷ তাদের বিরুদ্ধে কাউকে জোর গলায় প্রতিবাদও করতে দেখিনা৷

একটা বিষয় আগেই পরিষ্কার করে নেই: হালাল উপায়ে যেসব নারী আয় উপার্জন করছেন এই প্রবন্ধে আমি তাদের নিয়ে বলিনি। আমার মা অনেক বছর ধরে একজন ফিজিশিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। আমি নিজেও হার্ভার্ড থেকে পড়েছি। হার্ভার্ডে থাকতে তো ভাবতাম পাশ করে বের হয়ে ক্যারিয়ার গড়ে আমি পুরা দুনিয়াটাই বদলে দিব। যেসব বোন চাকরি করছেন তাদের আমি দোষ দেইনা কারণ তাদের মাঝে অনেকেরই অর্থনৈতিক অবস্থা করুণ ৷ দোষ এই পুরো সমাজ ব্যবস্থার যেখানে নারীকে চাকরি ও ক্যারিয়ারের মধ্যে নিজের সম্মান ও যোগ্যতা খুঁজতে বাধ্য করা হচ্ছে। ভাবা হয় কোনো মহিলা চাকরি করছেনা মানে তার কোনো মূল্য নেই, যোগ্যতা নেই।

আমি নিজেও এই ব্যাপারটা নিয়ে বহুদিন দ্বিধাদ্বন্দে ভুগেছি ৷ শুধু একজন স্ত্রী আর মা হওয়ার বাইরে কি আমার আর কোনো যোগ্যতা নেই? অনেক বছর পর আমার উপলব্ধি হয়েছে যে এই প্রশ্নটাতেই আছে আসল সমস্যা ৷ আসলে একজন স্ত্রী আর মা হওয়ার চেয়ে বড় ব্যাপার আর কিই বা হতে পারে? এর চেয়ে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার আর কি হতে পারে? আর কোন বিষয়টা নারী সত্তাকে এভাবে পূর্ণতা দেয়? একজন স্ত্রী এবং মাই পারে একটা সুন্দর, প্রেমময়, আলোকিত পরিবার ও সংসার গড়ে তুলতে। মুসলিম সমাজে এবং উম্মাহতে এমন সাংগঠনিক ভূমিকা আর কে রাখতে পারে?

কিন্তু নারীবাদ আমাদের নারীদের এর বাইরে গিয়ে “আরো বেশি” হতে বলে। বলে “নিজেদের সব সম্ভাবনাকেই কাজে লাগাও। এভাবেই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করো।” নারীবাদ অনুযায়ী স্বামী সন্তানের পেছনে সময় ব্যায় করার চেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অর্থ উপার্জন করে কর্মক্ষেত্রে সম্মান আর পদমর্যাদা খুঁজে বেড়ানোতেই আছে নারী জীবনের পূর্ণতা ৷ কিন্তু বাস্তবে লাভের চেয়ে এখানে ক্ষতির পরিমাণটাই বেশি। এমন শোচনীয় অবস্থা আর বিধ্বংসী মানসিকতার জন্য দায়ী পুরো আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা। আর আমরা এর ভুক্তভোগী। তবে আমরাই পারি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ থেকে রক্ষা করতে৷

কিন্তু দুর্ভাগ্য, অনেক মুসলিম আছে যারা এই আদর্শকে অনুসরণ করছে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা স্থায়ীভাবে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা করছে।

আমাকে কেউ বিয়ে করতে চায় না কেন?

গত সপ্তাহে একজন মুসলিম আইনজীবী এবং এক্টিভিস্ট জাহরা বিল্লুর ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম ৷ পোস্টে সে বলেছে তার এই উচ্চমার্গীয় ক্যারিয়ারের জন্য নিজের বিয়ের পাত্র খুঁজে পেতে বাজে রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এর জন্য সে দায়ী করছে মুসলিম পুরুষদের এবং তারপর পুরো মুসলিম কমিউনিটিকে!

আমি অনুরোধ করবো তার পোস্টটা মনোযোগ দিয়ে পড়ার। মুসলিমদের মাঝে বিয়ে এবং সংসারে নারী পুরুষের আলাদা ভূমিকা (gender roles) নিয়ে যে মারাত্মক ভুল ধারণা প্লেগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে তা একটু আঁচ করা যাবে ৷

তার পোস্টে সে বলছিল এক রেস্টুরেন্টে তার একজন বাবার সাথে দেখা হয়। সেই বাবা বলছিলেন যে তিনি চান তার মেয়ে যেন বড় হয়ে বিল্লুর মতো হয়। বিল্লুর কাছে এমন ঘটনা খুব সাধারণ। অনেকেই তাকে এমন কথা বলে, এমনকি অনেক পাত্রও তাকে এমন ধারণা দিয়েছে। একজন পাত্র নাকি তাকে বলেছিল:

“আমি চাই আমার মেয়ে যেন বড় হয়ে আপনার মতো হয়। কিন্তু আমার মনে হয়না আপনার সাথে সংসার করার মতো যোগ্যতা আমার আছে ৷ আমি চাইনা আপনি আমার জন্য নিজেকে বদলে ফেলেন।”

বিল্লুর কাছে এটা খুবই দুমুখো লাগে। আমার কাছেও তাই। কিন্তু আমাদের দুজনের এই ব্যাপারটা দুমুখো লাগার কারণ একদম ভিন্ন।

একজন বাবা নিজের মেয়ের জন্য এমন ক্যারিয়ার চাচ্ছেন যা কিনা বিয়ের জন্য পাত্র পেতে জটিলতার সৃষ্টি করবে, একটা সুস্থিত পরিবার গঠনে ঝামেলা করবে, সুন্নাহ অনুযায়ী চলতে বাধা সৃষ্টি করবে। একজন যোগ্য, স্নেহশীল বাবা কেন চাইবেন এই নারী এক্টিভিস্টদের মতো তার মেয়ে ভুক্তভোগী হোক?

কিন্তু বিল্লুসহ অন্য নারীবাদী চেতনার মানুষেরা মনে করে এমন আত্নত্যাগী ক্যারিয়ারিস্ট, কাজের প্রতি অনুরাগী চাকরিজীবী নারীদের বিয়ে না হওয়ার জন্য পুরুষরা দায়ী। কিন্তু তা কেন? পুরুষদের কি স্ত্রী পছন্দের ক্ষেত্রে কোনো প্রাধান্য থাকতে পারেনা? এতে অবাক লাগার কি আছে যদি বেশিরভাগ পুরুষের উচ্চমার্গীয় ক্যারিয়ারিস্ট নারীদের পছন্দ না হয়? এতে অবাক লাগার কি আছে যদি বেশিরভাগ পুরুষ এমন নারীদের পছন্দ করে যারা ইসলাম অনুযায়ী ঘর সংসার করা এবং মা হওয়ার প্রতি আগ্রহী?

স্ত্রীর মাঝে কেমন গুনাবলী দেখতে চায় তা পছন্দ করার অধিকার কি পুরুষের নেই? আধুনিক সমাজের নারীদেরও অবশ্যই নিজেদের জন্য স্বামী পছন্দ করে নেয়ার অধিকার আছে ৷ কেউ তো নারীদের এজন্য সমালোচনা করছেনা ৷ কম টাকা আয় করা বা খুব একটা ভাল চাকরি না করা পুরুষদের পছন্দ না করার জন্য তো কেউ নারীদের খোঁটা দিচ্ছেনা। মুসলিম নারীদের তো কেউ জোর করছেনা এমন পুরুষদের বিয়ে করতে ( No one is telling Muslim women to “Women up!” and marry “economically disadvantaged” men)। ফেসবুকে কেউ এমন টাকা-পয়সা কমওয়ালা, গরিবী হালতের পুরুষদের বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করে নাটকীয় পোস্টও দিয়ে বেড়ায় না।

আধুনিক নারীবাদ ক্ষমতায়িত নারী যারা উচ্চাভিলাষী ক্যারিয়ার, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতির জন্য নিজেদের বিলিয়ে দেয় তাদের উচ্চ আসনে বসিয়েছে মানে এই না যে আমাদের সবাইকে তা করতে হবে। আসলে আমাদের তা করা একদমই উচিত না। বিল্লুর অভিজ্ঞতায়, মুসলিম পুরুষরাও এসবের মূল্য দেয়না ৷ আর কেনইবা দিবে?

আধুনিক নারীবাদী চেতনার মানুষেরা (অমুসলিমরা এবং বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে তা ক্রমবর্ধমান) নারীদের জোর করে ক্যারিয়ারের জন্য নিজের স্বর্বস্ব দিতে বাধ্য করছে ৷ তারা বুলি ছড়ায় “ক্ষমতায়িত হও!” “নিজের পায়ে দাঁড়াও!”, ( “Be empowered!”, ” Be independent!” )। তারা বলে নারী আন্দোলনে যোগ দাও! Women’s March এ অংশ নাও (যেখানে কিনা এক্টিভিস্টদের মাথায় নারীর যৌনাঙগ আকৃতির হ্যাট থাকে)! একজন এক্টিভিস্ট হয়ে দুনিয়াটাকে বদলে দাও! পুরুষতন্ত্রকে গুড়িয়ে দাও! পুরুষেরা খুব খারাপ (অথবা স্বার্থপর আর অত্যাচারী)। তোমার স্বামী তোমাকে দাস বানিয়ে রাখবে। কাজেই একটা চাকরি করো। স্বামীর আদেশ মানার কোনো দরকার নাই বরং তুমি অফিসের বসের আদেশ মানো ! পুঁজিবাদের দাস হয়ে যাও। এটাই স্বাধীনতা। এটাই তোমাকে খুশি করবে। একজন পুরুষ যা করতে পারে নারীও তা করতে পারে। একজন পুরুষ যদি ক্যারিয়ারিস্ট হতে পারে, তাহলে নারী কেন পারবেনা?

নারীবাদ এই চেতনারই ধারক। কিন্তু ইসলাম তা বলেনা ৷ বরং ইসলাম এর বিপরীতে অবস্থান করে।

তাহলে এমন স্ত্রী চাওয়াতে দোষের কি আছে যে ক্যারিয়ারের চেয়ে তার পরিবারকে প্রাধান্য দেয়? এমন স্ত্রী চাওয়াতে দোষের কি আছে যে স্বামী সন্তানদের জন্য নিজেকে নিবেদিত করতে আগ্রহী?

বাসায় তৈরী খাবারের মূল্য

বিল্লুর পোস্টে সে আরো বলে:

“মানুষ দূর থেকে নারী এক্টিভিস্টদের সমর্থন করে ঠিকই কিন্ত নিজের বাসায় বা পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে তা করেনা ৷ যেন তারা শুধু এই ধারণাটাকেই সমর্থন করছে। আসলে পরিবারে কাউকে সমর্থন করতে হলে তো নিজেদের আরাম আয়েশ আর বাসায় তৈরী খাবার উপভোগ করাকে বিসর্জন দিতে হবে।[female activists]

অবশ্যই নিজ পরিবারের ক্ষেত্রে কেউ এটা সমর্থন করতে চাইবেনা!

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একজন স্বামী যখন বাসায় ফেরে তখন একটু আরাম আয়েশ আর বাসার আদরে বানানো খাবার আশা করা কি অযাচিত ব্যাপার? সংসার জীবনে এমন ইচ্ছা করা কি খারাপ কিছু? নাকি সেক্সিস্ট?

নারীদেরও নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত এভাবে সংসারের দায়িত্বগুলোকে অবমূল্যায়ন করা আদৌ কোনো সুফল বয়ে আনছে কিনা? প্রতিদিনই আমরা অনলাইনে ৩০-৫০ বছর বয়সী ক্ষমতাশালী ক্যারিয়ারিস্ট নারীদের হাহাকার শুনি। এই নারীরা বিয়েও করেনি এবং সন্তানহীন ৷ “জীবনের সবচেয়ে উপযোগী সময়গুলো কেন ক্যারিয়ারের পেছনে নষ্ট করলাম? এই সময়গুলো কেন একটা পরিবার গড়ে তোলার কাজে লাগালাম না? এখন আমার সন্তান ধারণের ক্ষমতাও নেই। তাই যেসব পুরুষ সন্তানদের নিয়ে সুখি পরিবার চায়, তারা আমাকে পছন্দ করেনা ৷ তাদের আমি দোষও দিতে পারিনা।”

কেউ কি তাদের মেয়েদের জন্য এমন শোচনীয় পরিণতি চায়?

নারী জীবনে সর্বোচ্চ সুখ আর পরিপূর্ণতা এনে দিতে পারে সন্তান জন্ম দেয়া আর ভালবাসায় আগলে রেখে তাদের বড় করে তোলা ৷ অথচ নারীবাদ এগুলোকে মনে করে অপ্রয়োজনীয়। স্ত্রী এবং মা হওয়ার জন্য যৌবনের সবচেয়ে উপযোগী সময়টা তাদের অন্যকিছুর পেছনে ছুটতে বাধ্য করা হয়। এই মতবাদ শুধু ধ্বংসই ডেকে আনতে পারে ৷ অনেক মুসলিম তো এখন এই বিধ্বংসী মতবাদ ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।

একজন পুরুষ আর নারী কখনোই এক না ( যতোই আপনি তা মনে করেন না কেন )!

নারীকে পুরুষের মতো করে ফেলা নারীবাদের আরেক ধারা ৷ বিল্লু তার পোস্টে বলেছে:

“আমার কাজে আমাকে অধিক সময় দিতে হয় এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাজের জন্য কাজ করে যেতে হয় ৷ এটা আমার জন্য আল্লহর নির্ধারিত পথ।”

নিজেদের প্রশ্ন করি: পরিবার ফেলে রেখে ঘরের বাইরে গিয়ে “অধিক সময়” কাজ করে “জীবনের ঝুঁকি” নেয়া কি ইসলাম অনুযায়ী নারীর দায়িত্ব? ইসলামের কোন দলিলে নারীদের এ কাজ করতে বলা হয়েছে? ইসলাম কি আদৌ এই কাজের অনুমোদন দেয়?

বরং ইসলামে ভরণপোষণ, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার কাজ পুরুষের। নিজের জীবন ঝুঁকিতে রেখে ঘর-পরিবার, সমাজ ও উম্মাহকে রক্ষা করা নারীর নয়, পুরুষের দায়িত্ব ৷ সংকটময় মুহূর্তে বা ইমারজেন্সিতে নারী অবশ্যই তার পরিবারকে রক্ষা করবে, কিন্তু এই দায়িত্ব সাধারণভাবে আল্লহ নারীদের দেননি। এই দায়িত্ব আল্লহ দিয়েছেন মুসলিম পুরুষদের।

নারী পুরুষ উভয়েরই নিজেদের স্বতন্ত্র গুণাবলি আছে, দুর্বলতা আছে। কিন্তু নারীবাদ সমন্বিতভাবে পুরুষ বা মেয়েলি বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করে এবং জোরপূর্বক সকল গুনাগুনকে পুরুষের বৈশিষ্টের মাপকাঠিতে বিচার করে। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি দিন দিন লিঙগ বা জেন্ডারের ধারণাই বিলুপ্তির পথে! মানুষ যুদ্ধ ঘোষণা করছে পুরুষতন্ত্র এবং নারীত্বের বিরুদ্ধে। বলাই বাহুল্য, পুরুষত্ব হলো নারীবাদের ভাষায় toxic masculinity( অশুভ ব্যবস্থা, তিক্ত বিষ) আর নারীত্ব হলো দুর্বলতা।

ইসলামী ব্যবস্থা এর একদম বিপরীতমুখী ৷ ইসলামী দলিলে সুস্পষ্টভাবে নারী পুরুষের বৈশিষ্টগত পার্থক্য এবং দায়িত্বসমূহের আলোচনা রয়েছে। ইসলামে বিয়ে এবং পরিবার বিকাশকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং সংসারে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত। লিঙগভেদে প্রত্যেকের নির্দিষ্ট অধিকার এবং দায়িত্ব আছে ৷ একজন স্বামী হলো পরিবারের নেতা যার কাঁধে দায়িত্ব তার স্ত্রী ও সন্তানদের দ্বীন, তাকওয়া ও মূল্যবোধকে সঠিকপথে পরিচালিত করা ( এর জন্য তাকে আল্লহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে)।

একজন স্ত্রী হবে স্বামীর নিবেদিত সাহায্যকারী। সে তার স্বামীর অনুগত হবে এবং দ্বীনি মুসলিম পরিবার গঠনে একসাথে কাজ করে যাবে। পরিবারের নেতা হিসেবে স্বামীর কাঁধে থাকে অনেক গুরুদায়িত্ব। যেমনঃ পরিবারের ভরণপোষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ধর্মীয় শিক্ষা, স্ত্রী সন্তানদের যত্ন করা এবং তাদের প্রয়োজনকে কোনোভাবেই অবহেলা না করা, তাদের অত্যাচার না করা । এগুলো হলো একজন মুসলিম স্বামীর দায়িত্ব এবং তার স্ত্রীর অধিকার ৷ তেমনিভাবে একজন মুসলিম স্ত্রীর দায়িত্ব সঙগী হিসেবে তার স্বামীর সন্তুষ্টির প্রতি নজর রাখা, স্বামীর অনুগত হওয়া এবং তার অনুপস্থিতিতে নিজের, সন্তানের এবং পরিবারের খেয়াল নিশ্চিত করা। এগুলো স্বামীর অধিকার। দায়িত্বের এমন বন্টন সবচেয়ে কার্যকরী ও সুষম যেখানে প্রত্যেকে তাদের সহজাত গুনাবলীকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে পারে ৷

আমরা যদি একটু বোঝার চেষ্টা করতাম তাহলে দেখতাম আল্লহর দ্বীন ইসলামের হিকমাহ নারীবাদের অসাড়তার চেয়ে কত কোটি গুণে উত্তম! ঐশী বাণী ন্যায়ের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত।

বিল্লুর পোস্টে ফিরি:

“যদিও বা রেস্টুরেন্টের সেই বাবাকে আমি এই কথা বলিনি তবে আমার পোস্ট যারা পড়ছেন তাদের উদ্দেশ্য বলতে চাই। নিজেদের মেয়েদের এক্টিভিস্ট এবং লিডার হিসেবে গড়ে তোলা যথেষ্ট নয়৷ বরং এর সাথে আপনাদের ছেলেদেরও শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা বড় হয়ে ” ফ্রন্টলাইন” এ থাকা নারীদের সাপোর্ট করার মানসিকতা রাখে। আমরা আমাদের পরিবার ও সমাজের সাহায্য ছাড়া একা এ কাজ করতে পারবোনা।”

কিইই!!!

মেয়েদের এক্টিভিস্ট ও লিডার হিসেবে গড়ে তোলা কেন মুসলিম সমাজের আদর্শ হতে যাবে? ইসলামে কি নারীদের কোনো যুদ্ধের “ফ্রন্টলাইন” এ থাকার আদেশ দিয়েছে? ইসলাম কি নারীদের এমন কোনো কাজে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয় যেখানে তাদের ক্যারিয়ারের প্রতি অতিরিক্ত ফোকাস দিতে হবে, মাহরাম ছাড়া কোথাও যেতে হবে, পরিবার থেকে দূরে থাকা হবে, অন্য পুরুষদের সাথে মিশে আন্দোলন করতে হবে, রাস্তায় মিছিল সমাবেশ করে স্লোগান দিতে হবে এবং পুরুষদের মতো যুদ্ধে নামতে হবে? আমরা যতোই উপেক্ষা করতে চাইনা কেন এগুলো হলো ইসলাম অনুযায়ী শালীনতা এবং নীতিবিরোধী৷

দয়া করে ভুল ও অযৌক্তিক রেফারেন্স দেয়া বন্ধ করুন!

মুসলিম এক্টিভিস্টদের একটা কৌশল হল তাদের নীতিবিরোধী কাজগুলোকে তারা সাহাবাদের সময়ের বিভিন্ন উদাহরণ এর সাথে মিলিয়ে প্রচার করে। অথচ তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিল্লুর পোস্টে সে বলে:

” আমি অনুপ্রাণিত হই উম্মুল মুমিনীন, রাসূল (সা) এর নারী সাহাবীগণ ও ইসলামি আন্দোলনের নারী নেত্রীবৃন্দ এবং সেই বোনদের দেখে যারা আমার সাথে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। তাদের ভালবাসা, সাপোর্ট করা, উৎসাহ দেয়া ইসলামি বিশ্বাসের অংশ ৷ মুসলিম পুরুষদের আর ছেলে সন্তানদের আমাদের এই শিক্ষা দেয়া দরকার।”

দয়া করে এই জঘন্য উচ্ছৃঙ্খলের মাঝে সাহাবীদের জড়াবেন না। রসূল (সা) এর সময়ে কোন মুসলিম পুরুষ এমন নারী বিয়ে করেছেন যে ইসলাম অনুযায়ী সংসারের দায়িত্ব পালন না করে ঘন্টার পর ঘন্টা বাইরে কাজ করে আর রাস্তায় মিছিল করে বেড়ায়?

বিল্লু যেভাবে উম্মুল মুমিনীন এবং রসূল (সা) এর নারী সাহাবীদের এমন নারীদের সাথে একই কাতারে ফেলার ইংগিত করেছে তা অসততাই মাত্র ৷ এখনকার সময়ের সেক্যুলার নারীবাদী আদর্শকে (যেমনঃ নারী স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক আন্দোলন ইত্যাদি) রসুল (সা) এর বরকতময় সর্বোত্তম প্রজন্মের সাথে জোর করে মিলানো ছাড়া এ আর কিছুই নয়। ইসলামের স্বর্ণালী ইতিহাসের সাথে তা মিলানো বিভ্রান্তিকর, বানোয়াট ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজও বটে।

উম্মুল মুমিনীন ( আল্লহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হোন) নারীগণ কি আমাদের মতো জামা পরে বাইরে গিয়ে নারী-পুরুষের একত্র মিছিলে বক্তৃতা দিতেন? উনারা কি মাহরাম ছাড়া বাইরে গিয়ে এমন কাজ করতেন? উনারা কি কখোনও যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে বা সম্মুখে থাকতেন? বিশেষ করে হিজাবের আয়াত নাযিল হওয়ার পর?

সব প্রশ্নের উত্তর হলো: না।

নারীবাদ দ্বারা প্রভাবিত আমাদের পশ্চিমা মুসলিমদের একটা বাজে প্রবণতা হলো পূর্ববর্তী প্রজন্মের অধিকাংশ নারী যে প্রধানত একজন স্ত্রী এবং মা ছিলেন আমরা তা অস্বীকার করে বসে আছি । তারা যে কেউ “লিডার”, “এক্টিভিস্ট”, “সোশ্যাল জাস্টিস প্রটেস্টার” ছিলেন না আমরা মানতে চাইনা ৷ তাদের বেশিরভাগই আলেমা ছিলেন না ৷ সমাজে যথেষ্ট সংখ্যক আলেমা মজুদ থাকার জন্য একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা কোটা পূরণ করতে হবে এমন কোনো চাপও সে সময় ছিলনা।

খাদীজা ( রা) হলেন “Fortune 500 CEO” আর আয়েশা ( রা) হলেন পুরুষদের শিক্ষক৷ সিরিয়াসলি, এই কথা আর কত!?

হ্যাঁ, খাদীজা (রা) ছিলেন একজন সম্পদশালী নারী। কিন্তু সে সম্পদ তিনি পেয়েছিলেন মৃত স্বামীদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে। খাদীজা (রা) ব্যবসা করতেন কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে তিনি নিজে বাইরে যেতেন না বরং এ কাজের জন্য তিনি লোক নিযুক্ত করে রেখেছিলেন। হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে তিনি নিজেকে নিবেদিত করেছেন বরকতময় ও পবিত্র স্বামী রসুল (সা) এর প্রতি। তিনি রাসুল (সা) এর সংসারে ৬ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং তাঁর সাথে পরিবার গড়ে তুলেছেন। তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবীর প্রথম স্বস্তিদাতা এবং একনিষ্ঠ সাহায্যকারী। নবুয়্যতের আগেও এবং পরেও ৷ রাসূল (সা) এর প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসা এবং তাঁর যত্নের প্রতি তিনি এতো বেশি সতর্ক থাকতেন যে রাসুল (সা) হেরা গুহায় অবস্থানকালে খাদীজা (রা) সবসময় নিজের হাতে খাবার বানিয়ে তাঁর জন্য পাঠাতেন। আজকের দিনের কোন ক্ষমতাশালী সম্পদশালী মহিলা আছে যিনি এমন?

হ্যাঁ, আয়েশা (রা) ছিলেন অতুলনীয় মেধাবী এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার একজন বিজ্ঞ মানুষ। তিনি তাঁর জ্ঞান এই উম্মাহতে প্রেরণ করে দিয়েছেন। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হাদীসের বর্ণনাকারী তিনি। কিন্তু এসব কাজ তিনি করেছেন নিজের শালীনতা রক্ষা করে পরিপূর্ণ পর্দার বূহ্য রক্ষা করে।

মহান ব্যক্তিত্বের মহীয়সী পবিত্র নারী সাহাবীগণ যা করেছেন এখনকার দিনের নারী এক্টিভিস্টদের কাজের সাথে তার নূন্যতম মিল খুঁজতে যাওয়াটাই স্পর্ধার কাজ। এই নারী এক্টিভিস্টরা হলেন নিজেদের কল্পনার রাজ্যের এক একজন “স্বাধীন, শক্তিশালী, ক্ষমতায়িত মুসলিমাহ” আর সেই সুর ধরে তারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে “মুসলিম নারীর ক্ষমতায়ন” আন্দোলন। নিজেদের আপন খেয়াল আর ইচ্ছাকে জুতসই করার জন্য পূর্ববর্তী মুসলিমদের উদাহরণ দেয়া তাদের বন্ধ করতে হবে৷

বরং মুসলিম এক্টিভিস্টরা কেন এই বিষয়টার উপর জোর দেয় না যে রাসুল (সা) এর অন্যান্য স্ত্রীদের বেশিরভাগেরই তেমন সম্পদ ছিলনা এবং তাঁরা বিজ্ঞ আলেমাও ছিলেন না? কেন এটা ঘটা করে প্রচার করা হয় না যে,রাসুল (সা) এর এই স্ত্রীদের সময় কাটতো ইবাদাতে মশগুল থেকে, রাসূল (সা) এবং তাঁর অতিথিদের জন্য রান্না করে, রাসুল (সা) এর সন্তানদের যত্ন করায় এবং সংসারের দেখাশোনা করায়? উনারা কি উম্মুল মুমিনীন নন? ( আর এ কথা তো বলাই বাহুল্য, আম্মাজান আয়েশা (রা) রাসুল (সা) এর সংসারে রান্না করেছেন, যত্নআত্তি করেছেন এবং তাঁর দেখভাল করেছেন। )

এক্টিভিস্টরা কেন মারয়াম (আ) এর মতো পরহেজগার আল্লহর বান্দাকে নিয়ে জোরালোভাবে কথা বলে না?

ঈসা (আ) এর মা মারয়াম (আ) আল্লহর অতি অনুরাগী পুত পবিত্র বান্দা এবং একমাত্র নারী যার নাম কুরআনে উল্লেখিত আছে ৷ সুরা আলে ইমরানে আল্লহ তা’আলা বলেন: “এবং (এবার সেই সময়কার বিবরণ শোন) যখন ফিরিশতাগণ বলেছিল, হে মারয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে বেছে নিয়েছেন, তোমাকে পবিত্রতা দান করেছেন এবং বিশ্বের সমস্ত নারীর মধ্যে তোমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।” তিনি সকল নারীর জন্য আদর্শ । তাঁকে একজন মা হিসেবে সম্মানিত এবং বিশেষায়িত করা হয়েছে। ইসলামে একজন নারীর সম্মান তার মাতৃত্ব এবং পরিবারে তার ভূমিকার মাঝে নিহিত। চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, যোদ্ধা বা এখনকার দিনের নতুন উদ্ভাবিত অন্য কোনো ভূমিকায় নয়।

তাহলে কেন বিল্লু এবং অন্যদের দাবি যে “লিডার”, “ক্যারিয়ারিস্ট” নারীদের বিয়ে করা আমাদের “ইসলামি বিশ্বাসের অংশ”?

এ ধরণের দলিল প্রমাণহীন দাবি বাস্তবতাকে বিকৃত করে দেয় এবং অনেক মুসলিমের দ্বীনের বুঝকে বিপথে ঠেলে দেয়৷

পরিশেষে…..

উপরে যা কিছু লিখেছি তা পশ্চিমা সেক্যুলার নারীবাদী লেন্স থেকে দেখলে পিত্তি জ্বলে যাওয়ার মতো ব্যাপার মনে হবে। মুসলিম নারীবাদী এবং সোশ্যাল জাস্টিস এক্টিভিস্টদের মতে নারী পুরুষের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই, তাদের স্বতন্ত্র দায়দায়িত্ব নেই। তাদের মতে লিঙ্গ বা জেন্ডার হলো পুরুষতান্ত্রিক একটা প্রলাপ মাত্র যার বাস্তব অস্তিত্ব নেই। নারীবাদে বিয়ে এবং পরিবারকে অপ্রাসঙ্গিক এবং নিপীড়নমূলক হিসেবে দেখানো হয়, এমনকি একে ধর্ষণের সাথে তুলনা করা হয়। স্ত্রী হওয়া এবং সংসার চালানোকে উপহাস করে বলা হয় ” Domestic drudgery” বাংলায় যা হয় “ঘর সংসারের অহেতুক ফালতু কাজ”। মাতৃত্বকে ঘৃণা আর করুণার চোখে দেখা হয় যেন এটা ঘরের বাইরে কাজ করে মাস শেষে আসা বেতনের তুলনায় কোনো কাজই না ৷

সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো বিল্লুর মতো মুসলিম এক্টিভিস্টরা এই নারীবাদী আদর্শকে ইসলামের খোলস পরিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে । অথচ ইসলামে এসবের কোনো স্থান নেই।

About the Author: You can follow Umm Khalid on her Facebook page. She teaches online at Alasna Institute.

MuslimSkeptic Needs Your Support!
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments