
এনজিও-সমূহ যে দরিদ্র্য মুসলিমদের ‘সাহায্য’ করে, এটা কি আদৌ মুসলিমদের জন্য উপকারী কোন বিষয়?
‘টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) পদ্ধতি’-র উপর একটি কোর্সে অধ্যয়ন করার জন্য, আমি গত বছর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে অগ্রগণ্য একজন প্রফেসরের সান্নিধ্যে গিয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের ফান্ডিং উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পসমূহে (Projects) কাজ করে থাকি; এবং এসব প্রকল্পকে আরও দক্ষতার সাথে ব্যবস্থাপনা করার জন্য উক্ত কোর্সটি আমার জন্য ছিলো একটি দারুণ সুযোগ।
কিন্তু, আমাকে স্বীকার করতেই হবে, উক্ত কোর্সটি আমাকে আমার প্রত্যাশার চাইতেও বেশি কিছু দিয়েছিলো।
সময়ে সময়ে, গালে হাত দিয়ে বড় বড় চোখে অপলকভাবে আমি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, যখন কিনা তিনি আমাকে খুব আগ্রহের সহিত শিখাতেন- কিভাবে মুসলিমদেরকে অর্থাৎ আমার ভাই-বোনদেরকে ইসলাম থেকে বহু দূরে সরিয়ে নেওয়া যায়!
আমি জানি, এটা কতটা ভয়ানক ব্যাপার।
আমি এখানে এসেছিলাম কিভাবে উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ চালু করার মাধ্যমে একটি সম্প্রদায়ের জীবনধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে তাদেরকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে। আমি এসেছিলাম- কিভাবে শরনার্থী শিবিরে হাসপাতাল চালু করা যায়, কিভাবে গ্রামীণ জনপদসমূহে বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছে দেয়া যায়, কিভাবে জনবহুল নগর অঞ্চলে সঠিক স্যানিটেশন সেবা নিশ্চিত করা যায় ইত্যাদি বিভিন্ন সেবামূলক বিষয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে শিখতে।
আমি এগুলো শিখতে আসিনি- কিভাবে নারীর “ক্ষমতায়ণ” নিশ্চিত করা যায়, কিভাবে সমকামীতার প্রসার ঘটানো যায় অথবা, কিভাবে অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের বিরুদ্ধে চালু থাকা আইনসমূহের বিরুদ্ধে লড়া যায়। কিন্তু, আমাদের প্রত্যেকটি আলোচনার সাথে এ বিষয়গুলোই জড়িত থাকতো।
উদাহরণস্বরূপ, প্রথমদিককার ক্লাসগুলোতে আমাদেরকে ‘টেকসই উন্নয়নের ভিত্তিসমূহ’-এর পাশাপাশি, ‘নারীবাদ-এর ভিত্তিসমূহ’ সম্পর্কেও অধ্যয়ণ করতে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু কেনো?
পরবর্তীতে বুঝতে পারলাম, টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে এগুলো ভিন্ন কোন বিষয় নয়। টেকসই উন্নয়নের স্তম্ভসমূহকে তিনটি ‘E’ দ্বারা প্রকাশ করা হয়: Economy (অর্থনীতি), Environment (পরিবেশ) এবং Equity (সমতা)।
মূল বিষয়টা হলো- কম খরচে ও পরিবেশগতভাবে স্থিতিশীল পদ্ধতিতে, একটি ‘সমতা ভিত্তিক’ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। শেষ ‘E’ এর মধ্যেই যাবতীয় শয়তানি লুকিয়ে রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজে নারী পুরুষদের পৃথক পৃথক ভূমিকা হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সমকামীদের সাথে ভিন্নরকমভাবে আচরণ করা হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত যিনা আর বিয়ে একই হিসেবে গণ্য না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ‘সমতা নিশ্চিত হয়েছে’- একথা বলা যাবে না।
সব উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের রিপোর্টেই এই তৃতীয় স্তম্ভের (Equity) জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ থাকে। এই তথাকথিত সমতা ভিত্তিক সমাজ গঠনের পরিকল্পনা কি? এর জন্য কি পরিমাণ তহবিল বরাদ্দ হচ্ছে? এর সাথে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর পরিচয় কি?
পেছনের কথা
চিরাচরিত, ‘পশ্চাদপদ’ মুসলিম পুরুষরা কিভাবে বাংলাদেশে তাঁর প্রকল্পগুলোর বিরোধিতা করবে তা চিন্তা করে, অধ্যাপক সাহেব সময়ে সময়ে হাহাকার করতেন। কেননা, তিনি পুরো একটি মহিলা জনগোষ্ঠীকে কাজের জন্য ঘরের বাহিরে বের করে আনতে চেয়েছিলেন। তাদেরকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা, তার মূল লক্ষ্য নয়। মূলত, তিনি সমগ্র অঞ্চলে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এপ্লাই করে বাংলাদেশকে ‘প্যারিস’-এ পরিণত করতে চান।
কখনো আবার তিনি উগান্ডার প্রকাশ্য সমকামিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। এনজিও-গুলো দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বরাদ্দকৃত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন তহবিল আটকে রেখেছিল, যখন তারা জানতে পেরেছিলো, উগান্ডা সরকার সমকামী আচরণকে বেআইনি সাব্যস্ত করেছে। তারা একটি সমগ্র জাতিকে দুঃসহ দারিদ্র্যের মধ্যে আটকে রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না পুরুষ~পুরুষ পায়ুকাম প্রকাশ্যে অনুশীলন করার স্বাধীনতা দেয়া হচ্ছে!
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলোকে “উন্নয়নশীল” হিসেবে ঘোষনা করে, তাদের বিকাশে সহায়তা করার নামে, এনজিও-গুলো সারা বিশ্বজুড়েই নগদ অর্থ ঢালছে। এ প্রেক্ষিতে আমাদের মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত? যেমন : বিল গেটস এর কথা বিবেচনা করা যাক, যিনি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ‘উন্নয়ন প্রকল্পে’ এককভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন; এবং তাঁর সর্বশেষ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে তাদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়েছে: “সমতা”-র পশ্চিমা মানদণ্ডগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, এমনকি এর জন্য যদি কোন জাতির সংস্কৃতির বিনাশ ঘটাতে হয় কিংবা সে জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধসমূহকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলতে হয়, তারপরও।
উদাহরণস্বরূপ: ইইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সিরিয়ার উন্নয়নকল্পে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার জমা করেছে। সংঘাত বন্ধ হয়ে গেলে, এই তহবিল সিরিয়াতে স্থানান্তরের জন্য কি কি পূর্বশর্ত দেওয়া হবে বলে আপনি মনে করেন? “অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যশনাল”-এর মতো এনজিও ইতিমধ্যেই সিরিয়ায় তাদের কাজ শুরু করেছে:
“অনেক ব্যক্তিই, চুরি-ডাকাতি ছাড়াও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ‘আইনের অধীনে অপরাধমূলক নয়’- এরকম কাজের জন্য শাস্তির শিকার হয়েছে। এই ধরনের কাজের মধ্যে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং সাংস্কৃতিক সমাবেশে যোগদান, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এবং ফ্রি-মিক্সিং পার্টিতে যোগদান অন্তর্ভূক্ত ছিল।” (সোর্স)
হয় ধর্ম ত্যাগ করো, নতুবা না খেয়ে থাকো।
কোন পুতুল নাচ নয়
হার্ভার্ডে এসব অধ্যয়ন, আমার আবেগ-অনুভূতিকে চরমভাবে নাড়া দিয়েছিলো। নৈতিকতা ও উন্নয়ন পরস্পর বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। এজন্যই, পশ্চিমা দেশগুলো এভাবে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে ধর্মীয় ও নৈতিক সংস্কার (বিকৃতিসাধন) না ঘটিয়ে, দরিদ্র্য মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করতে পারে না। অর্থাৎ, পশ্চিমাদের সাহায্য-সহযোগিতা শর্তহীন কোন বিষয় নয়। পশ্চিমারা আমাদেরকে তথাকথিত ‘সহায়তা’ তখনই করবে, যখন আমরা তাদেরকে আমাদের প্রভু বলে স্বীকার করে নিব এবং তাদের বস্তাপচা আদর্শের দ্বারা আমাদের সুমহান ইসলামী আদর্শকে প্রতিস্থাপন করবো।
তাহলে কিভাবে এর মোকাবেলা করা যায়?
এ বিষয়টি অবশ্যই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। পশ্চিমাদের মাধ্যমে আসা যে কোন প্রকল্প গ্রহণ করার পূর্বে, সেগুলোর প্রত্যেকটি ক্ষেত্র সম্পর্কে সবিস্তারে অধ্যয়ণ করে নেয়া জরুরী; যাতে করে পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়। এটা অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমেই ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলোতে, পশ্চিমা উদারনৈতিক মূল্যবোধসমূহ (Western Liberal Values) সরাসরি রপ্তানি করা হচ্ছে।
স্পষ্টতার জন্য বলা দরকার, ইসলামেও উন্নয়ন ও নীতি-নৈতিকতা পরস্পর বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। পার্থক্য হলো, মুসলিমরা মানুষের জাগতিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার সময়- মানুষকে চিরন্তন সত্যের কাছাকাছি আসতে উৎসাহিত করে; অন্যদিকে পশ্চিমা উদারনৈতিক উন্নয়ন- মানুষকে মিথ্যা, ফাহিশা ও নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
এ বিষয়ে উদাহরণ পেশ করতে গেলে, সমসাময়িককালে যার নাম সবার আগে আসে, তিনি হলেন আবদুল রহমান আল সুমাইত (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনি ছিলেন একজন কুয়েতি ডাক্তার, যিনি আফ্রিকায় ২৯ বছর যাবৎ উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন। আল্লাহ্র ইচ্ছায় এবং তারপর তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়- আফ্রিকাতে প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় লাভ করেছে, ৫৭০০ টি মাসজিদ, ৮৬০ টি স্কুল, ৪ টি বিশ্ববিদ্যালয়, ১২৪ টি হাসপাতাল, ৯৫০০ টি কূপ নির্মিত হয়েছে; ৯৫০০০ শিক্ষার্থী পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছে, ১৫০০০ এতিম শিশুকে পরিচর্যা ও পুনর্বাসন করা হয়েছে… ইত্যাদি আরও বহু উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
আমরা চাই, এ ধরণের নিঃস্বার্থ, মানবহিতৈষী ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনের মাধ্যমে, দারিদ্র মুসলিমরা সাহায্য-সহায়তা পাক; কোন “ধর্মহীন, অরাজনৈতিক সুবিধাভোগী” মানবাধিকারকর্মী বা, এনজিও-সমূহের মাধ্যমে নয়। আমরা মুসলিমরা, যাকাত, সাদকায়ে জারিয়াহ, কর্জে হাসানার মাধ্যমে আমাদের আশেপাশের অভাবী লোকদের সাহায্য করতে চাই। কোন মানবতার ধ্বজাধারী কুফফার রাষ্ট্র, সংগঠন কিংবা এনজিওসমূহের নাচের পুতুলে পরিণত হতে চাইনা; ‘সাহায্য’ গ্রহণের অন্তরালে তাদের হাতে আমাদের উপর ছড়ি ঘুরানোর ও কর্তৃত্ব স্থাপনের এবং আমাদেরকে ধর্মহীন ও নির্বংশ করার চাবিকাঠি তুলে দিতে চাইনা।