১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান ভাগঃ ভাল নাকি মন্দ?

Jinnah (1876-1948) and Gandhi (1869-1948), "Father of the Nation" in Pakistan and India respectively.

পাকিস্তানের মুসলমানরা ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে তাদের “স্বাধীনতা” উদযাপন করে এবং পরের দিন ১৫ আগস্ট ভারতের মুসলমানরাও তাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে।

আমরা “স্বাধীনতা” কী এ নিয়ে বেশি কথা বলব না, যেখানে তথাকথিত “স্বাধীন” দেশগুলো বাস্তবিক অর্থে নিওলিবারাল বিশ্ব ব্যবস্থার শিকলে আবদ্ধ। এছাড়া এর গণতন্ত্রের মতো মতবাদকে মেনে নিয়ে বা আইএমএফের মত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জালে আটকে প্রতীকী জিজিয়া দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এর পরিবর্তে, আমরা খুঁজব করব এই বিভাজনটি কি “কল্যাণকর” নাকি “প্রয়োজনীয়” ছিল।

এই বিষয়টি দুই দেশের মুসলিমদের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানের মুসলমানেরা সমসাময়িক ভারতের মুসলমানদের অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাবে। ভারতের মুসলমানরা অবশ্য যুক্তি দেবে, বর্তমান যে পরিস্থিতিতে তারা রয়েছে তা দেশ ভাগের প্রত্যক্ষ পরিণতি, কারণ এটি ছাড়া তারা “সংখ্যায় আরও বেশি” এবং আরও “শক্তিশালী” হতো।

আমার এটা জানানো উচিত আমি নিজে, নিবন্ধটির লেখক, আমার পাকিস্তানের (আজাদ কাশ্মীর অঞ্চল) সাথে সম্পর্ক রয়েছে । তবুও, ইন্শা-আল্লাহ, আমি উভয় পক্ষের সমস্ত যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তি বিবেচনায় নিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং বিস্তীর্ণ মূল্যায়ন উপস্থাপন করতে চাই।

অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন নিবন্ধটিতে শুধু “তত্ত্বের” এর একটি বিশ্লেষণ করা হবে। তাই দেশভাগের সময় ভুক্তভোগী ও ক্ষয়-ক্ষতির সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। এই ধরনের ক্ষয়-ক্ষতির বিশদ বিবরণ অনেক বিস্তারিতভাবে অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং পাকিস্তান আন্দোলন উভয়েরও অনেক আগে দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

ভারতীয়-মুসলিমরা যারা পাকিস্তান আন্দোলনের সমালোচনা করে তারা প্রায়শই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে এই আন্দোলনের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তাকে সমালোচনা করে।

কেউ কেউ তার শিয়া ঐতিহ্যের ভিত্তিতেও তাকে তাচ্ছিল্য করে। তবে, অনেকে বিবেচনা করেন তিনি পরবর্তীতে সুন্নি-ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং এটি দ্বারা প্রমাণ করা যেতে পারে যে তার জানাযার নামাযে মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী, একজন নেতৃস্থানীয় দেওবন্দী আলেম ইমামত করেছিলেন। এবং অবশ্যই, দেওবন্দীদেরকে শিয়াদের প্রতি কোন অনুরাগ থাকার জন্য অভিযুক্ত করা নিষ্ফল।

একটি আরও উল্লেখযোগ্য অভিযোগ হল যে জিন্নাহ কখনোই ব্রিটিশ-শৈলীর উদারনীতিকে পরিত্যাগ করেননি, এর সাথে আসা সমস্ত আধুনিকতাবাদী ধারণা যেমন গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র এবং এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতা।যা তিনি লন্ডনে একজন আইনজীবী হিসেবে ছাত্রাবস্থায় গ্রহণ করেছিলেন।

এই বিষয়ে পরে বলা যাবে।

কিন্তু ভারতীয়-মুসলমানদের একটি সহজ সত্যকে মেনে নিতে হবে। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ধারণা (হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি ভিন্ন জাতি) “পাকিস্তান” শব্দটি বাস্তবে পরিণত হওয়ার এবং জিন্নাহ’র অনেক আগে থেকে বিদ্যমান ছিল।

ভেঙ্কট ধুলিপাল’র ২০১৪-এর বই, ক্রিয়েটিং এ নিউ মদিনা।এখানে ব্যাখা করেছেন কিভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের গতিশীলতা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিত্ব জিন্নাহকে অতিক্রম করেছিল। মুসলিম জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, উর্দু সংবাদপত্র এবং কিছু ইসলামিক বুদ্ধিজীবীরঃযেমন পূর্বোক্ত মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী, যিনি মাওলানা আশরাফ আলী আল-থানভীর ছাত্র (সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী দেওবন্দী পণ্ডিতদের একজন এবং যিনি হিন্দুদের সাথে একটি দেশ গঠনের বিপক্ষে ছিলেন) অবদানও উল্লেখযোগ্য।

ভেঙ্কট ধুলিপাল মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানীকে উদ্ধত করেছেন, (পৃষ্ঠা-৩৫৩)

বস্তুবাদের ঘূর্ণিতে আটকে থাকা এবং নাস্তিকতার অন্ধকারে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে থাকা বিশ্বের কাছে পাকিস্তান আলোর বাতিঘর হয়ে উঠতে চায়।

পাকিস্তানের সৃষ্টির জন্য মাওলানা শাব্বির আহমদ আল-উসমানীর যুক্তি নিম্নরূপ বর্ণনা করা হয়েছে, (পৃষ্ঠা ৩৬০-৩৬১)

উসমানি পাকিস্তানকে ইতিহাসের প্রথম ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে গৌরবান্বিত করেছিলেন যেটি মদিনায় নবী(সাঃ) তৈরি ইসলামী আদর্শ রাষ্ট্র পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে। তিনি জনগণের মনে এদের পরিচয়কে দৃঢ় করার জন্য ক্রমাগত পাকিস্তান এবং মদিনা শব্দ দুটিকে বিনিময়যোগ্যভাবে ব্যবহার করেন। উসমানি পাকিস্তানের বৈশ্বিক ঐতিহাসিক তাৎপর্য প্রাথমিক ইসলামি ইতিহাস থেকে শক্তিশালী রূপক ব্যবহার করে ব্যাখ্যা করেছেন । তিনি উল্লেখ করেন যে, নবী(সাঃ) জন্মভূমি মক্কায় পবিত্র ভূমি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তিনি প্রথম পবিত্র ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য মদিনায় হিজরত করেছিলেন। উসমানি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে জোর দিয়েছিলেন যে, নবী(সাঃ) এর হিজরতের সিদ্ধান্ত ছিল পবিত্র ভূমি কেবলমাত্র এমন একটি অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যেখানে মুসলমানরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে। কারণ এটি শুধুমাত্র এমন একটি ভূমি ছিল যেখানে মুসলিম সম্প্রদায় তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকাশিত হতে পারত। মক্কার সমাজের প্রভাবশালীদের মধ্যে তাঁর শিক্ষার প্রতি অদম্য বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে, এটি মক্কায় সম্ভব হতো না, এজন্য হিজরতের প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য। উসমানি যুক্তি দিয়েছিলেন মদিনার মতো একটি ইসলামী রাষ্ট্র অবিভক্ত ব্রিটিশ-পরবর্তী ভারতে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, এমনকি প্রদেশগুলিতে ব্যাপক ক্ষমতা হস্তান্তর করেও না, কারণ হিন্দুরা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে কেন্দ্রে সর্বদা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই পাকিস্তানের একটি পৃথক এবং সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হওয়া দরকার। যেখানে মুসলমানরা শরীয়তের অধীনে এবং অনৈসলামিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।

উসমানি ইসলামের জন্য পাকিস্তানের তাৎপর্যের রূপরেখা দিয়েছিলেন, এটি হবে আধুনিক যুগে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির প্রথম পদক্ষেপ। জাতি, শ্রেণী, সম্প্রদায়, ভাষা ও অঞ্চলের ভিত্তিতে তাদের পূর্বের সংকীর্ণ পরিচয়গুলি থেকে তাদের মুক্ত করা এবং ইসলামের সমান ভ্রাতৃত্ব তৈরী করা, যেমনটি হয়েছিল তেরো শত বছর আগের মদিনায়।

পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে মাওলানা শাব্বির আহমাদ আল-উসমানীর যুক্তি ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় প্রকৃতির। এটা ছিল স্বাভাবিক উপলব্ধি। মুসলিম এবং হিন্দুদের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে বিপরীত। পরবর্তীতে, তারা নিছক সংখ্যার জোরে মুসলমানদের জীবনের সিদ্ধান্ত নিবে।

RELATED: Phallus Worship in Hinduism: How Hindus See the Shivling Everywhere

প্রকৃতপক্ষে, যুক্তিটি এতটাই স্বচ্ছ আপনি অবাক হবেন না যে তত্ত্বটি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, স্যার সাইয়্যেদ আহমদ খান, মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী প্রমুখের থেকেও শতাব্দী পুরাতন।

আকবর এস আহমেদ (“ইসলামিক নৃবিজ্ঞান” এর অগ্রদূত হিসাবে বিবেচিত) জিন্নাহ উপর লিখিত সেরা বইগুলির মধ্যে একটিঃ জিন্নাহ, পাকিস্তান এবং ইসলামিক পরিচয় এ লিখেছেন, (পৃষ্ঠা ১২০-১২১)

অনেক বুদ্ধিজীবী দ্বি-জাতি তত্ত্বের সাথে পাকিস্তান আন্দোলনকে মিলিয়েছেন। স্যার সাইয়িদ সমর্থন করেছিলেন ভারতের হিন্দু এবং মুসলমানরা আলাদা মানুষ এবং তাদের আলাদা-আলাদাভাবে বসবাস করা দরকার। আমি বলব আমাদের উচিত মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম পদচিহ্ন খোঁজা। বাংলায় হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়াঁ এবং উত্তর ভারতে সৈয়দ আহমদ বেরেলভী উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পাকিস্তানে পরিণত হবে এমন দুটি অঞ্চলের কৃষকদের উপর ভিত্তি করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

শিখদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বেরেলভি ছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহর পুত্র আবদুল আজিজের অনুসারী। শাহ ওয়ালিউল্লাহ হিন্দু ধর্মের জোয়ারকে প্রতিহত করার জন্য আহমদ শাহ আবদালি(যিনি সবেমাত্র আফগানিস্তানের উপজাতিদেরকে একটি জাতিতে পরিণত করেছিলেন) এবং ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে একটি জোট গঠনে সাহায্য করেছিলেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ লিখেছিলেনঃ ‘আল্লাহ না করুন, কাফেরদের আধিপত্য চলতে থাকলে মুসলমানরা ইসলামকে ভুলে যাবে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই এমন একটি জাতিতে পরিণত হবে যে তাদের অমুসলিমদের থেকে আলাদা করার কোন চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে না’ (সাঈয়েদ ১৯৬৮ঃ৪)। শাহ ওয়ালীউল্লাহ ভারতে মুসলমানদের সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা স্পষ্ট করেছিলেনঃ ‘আমরা এমন আরব জনগণ যাদের পিতারা হিন্দুস্তানে নির্বাসনে পতিত হয়েছেন এবং আরবি বংশবৃত্তান্ত এবং আরবি ভাষা আমাদের গর্ব’ (জেমস এবং রায় ১৯৯২ঃ৩২)। সাইয়্যেদ আহমদ বেরেলভী এক শতাব্দী পরে তাকে প্রতিধ্বনিত করেছিলেনঃ ‘আমাদের অবশ্যই নবীর শিক্ষার পরিপন্থী সেই সমস্ত ভারতীয়, ফার্সি এবং রোমান প্রথা বর্জন করতে হবে’।
(…)
ওয়ালীউল্লাহ, বেরেলভী ও শরীয়তউল্লাহর মতো সংস্কারকরা জাতিসত্তার আধুনিক অর্থে পাকিস্তান দাবি করছিলেন না। তবে, তারা মুসলমানদের জন্য সৃষ্ট সংকট সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। ইসলামী পরিচয়ের অনুসন্ধান প্রকাশ করতে মাওলানা সাইয়্যেদ একটি আধুনিক বাক্প্রণালী দিয়েছিলেন।

তাই, আহমেদ দ্বি-জাতি তত্ত্বকে মহান মুসলিম পণ্ডিত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (সাধারণত ভারতে ইসলামের পুনরুজ্জীবনকারী হিসাবে বিবেচিত) এর সাথে যুক্ত করেছেন। যিনি ছিলেন জিন্নাহ এবং অন্যান্যদের শতবর্ষ পূর্বের।

অন্যরা যুক্তি দেখান যে শাহ ওয়ালীউল্লাহর এক শতাব্দী আগে, প্রভাবশালী আহমদ সিরহিন্দি (মুজাদ্দিদ আলফ থানি নামে পরিচিত) দ্বি-জাতি তত্ত্বের বীজ বপন করেছিলেন। যখন তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের “দ্বীন-ই-ইলাহী” নামক সমন্বিত ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।

এই সব কিছুর মূল বিষয় হল এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করা যে, দ্বি-জাতি তত্ত্ব পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক শতাব্দী আগে থেকে বিদ্যমান।

এটা বিশ্বাস করা স্বাভাবিক যে মুসলমান এবং হিন্দুরা প্রতিটি দিক থেকে অনেক আলাদা।যা একটি একক একীভূত “জাতি” গঠনে প্রতিবন্ধক। ভারতীয়-মুসলিমরা নিজেরাই বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছে, বিশেষ করে ২০১৪ থেকে যখন মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তাদের “জাতির” নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল।

যেটাকে পাকিস্তান আন্দোলনের ইশতেহার হিসাবে বিবেচনা করা হয় (যেখানে “পাকিস্তান” শব্দটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল), ১৯৩৩-এর প্যামফলেট –এখন বা কখনই না, চৌধুরী রহমত আলী বিষয়টির সারসংক্ষেপ করেছেন:

আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আমাদের সামাজিক নিয়ম ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আমাদের উত্তরাধিকার আইন, উত্তরাধিকার এবং বিবাহ ভারতের বাকি অংশে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। যে আদর্শগুলি আমাদের জনগণকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে অনুপ্রাণিত করে তা হিন্দুদের অনুপ্রাণিত করার আদর্শ থেকে ভিন্ন। এই পার্থক্যগুলি শুধু প্রধান এবং মৌলিক নীতিমালার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এগুলো আমাদের জীবনের ক্ষুদ্রতম বিবরণ পর্যন্ত প্রসারিত। আমরা একত্রে ভোজন করি না; আমরা আন্তঃবিবাহ করি না। আমাদের জাতীয় রীতিনীতি ও পঞ্জিকা, এমনকি আমাদের খাদ্যাভ্যাস,পোশাক ও ভিন্ন।
(…)
এগুলি সত্য–কঠিন তথ্য এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতা যা আমরা যে কাউকেই খণ্ডন করতে চ্যালেঞ্জ করি। এই ধরনের তথ্য ও বাস্তবতার ভিত্তিতে আমরা দ্বন্দ্বের ভয় ছাড়াই দৃঢ়ভাবে বলি যে, আমরা পাকিস্তানের মুসলমানরা, ভারতের হিন্দুদের থেকে একটি স্বতন্ত্র জাতীয়তার অধিকারী, বসবাসের অধিকার রয়েছে ভারতের বেশিরভাগ অংশে এবং আমরা প্রাপ্যতা দাবি করি,পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল সংবিধানের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় মর্যাদার স্বীকৃতি, বাকি ভারতের থেকে আলাদা।

এমনকি যদি আপনি একজন ভারতীয়-মুসলিম হন, যিনি পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধে, আপনি কি সৎভাবে দাবি করতে পারেন যে এই লাইনগুলি ভুল?

তবে, পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণা কী?

আমরা দ্বি-জাতি তত্ত্ব এবং পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমি বোঝার চেষ্টা করেছি এবং দেখেছি ভারতীয়-মুসলিমরা একজন ব্যক্তি হিসাবে জিন্নাহকে সবকিছুর জন্য দায়ী করে, যা অন্যায় যেহেতু এর ইতিহাস তাঁরও হস্তক্ষেপের থেকে ঊর্ধে।

কিন্তু তারা একটি বিষয়ে ঠিক, যখন তারা বলে পাকিস্তান সৃষ্টির সমস্ত প্রতিশ্রুতি এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি, কারণ জিন্নাহ থেকে শুরু করে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী অভিজাতরা ছিল উদার-ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী।

RELATED: Sell-Out “Scholars” Using Sialkot Incident in Pakistan for Reform Agenda

স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যান্য ভারতীয় নেতাদের মতো জিন্নাহও তার প্রাথমিক পরামর্শদাতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলের মতো ছিলেন একজন উদার-আধুনিকতাবাদী। তিনি আগ্রহের সাথে বেন্থাম এবং মিলের মতো উপযোগবাদী দার্শনিকদের পড়তেন।

তাই তার “মুসলিম জাতীয়তাবাদে” প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় পরিচয়ের পরিবর্তে রাজনীতিক পরিচয়ের গুরুত্ব বেশি ছিল। আর এই কারণেই আজ অবধি বিতর্ক রয়েছে, জিন্নাহ একটি ইসলামী রাষ্ট্র নাকি মুসলমানদের জন্য একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি অবশ্যই রাষ্ট্র-ধর্মনিরপেক্ষতার অনুমতি দেবে।

আপনি বলতে পারেন যে পাকিস্তানের প্রথম দিকের সমস্ত নেতা একইভাবে তৈরি হয়েছিল: তারা ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছিল এবং উদার-আধুনিকতাবাদী ধারণাগুলি গ্রহণ করেছিল।

উদাহরণস্বরূপ, জেনারেল আইয়ুব খান (দেশের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক যিনি ১৯৫৮-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন) এই “মুসলিম আধুনিকতাবাদীদের” একজন ছিলেন। তিনি “মোল্লাদের” ঠাট্টা করতেন এবং ফজলুর রহমান মালিকের মতো একজন ক্রিপ্টো-কোরানিস্টের সাথে মিত্রতা করেন যার মতবাদের জন্য দুঃখজনকভাবে এখনও ইন্দোনেশিয়ার মতো দূরবর্তী দেশগুলিতেও ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

পাকিস্তানি রাষ্ট্র আজ অবধি পাকিস্তানের মুসলমানদের মডার্ণ করে চলেছে। প্রায়শই নারী শিক্ষা চাপিয়ে দিয়ে; সাধারণত রাজনীতি এবং মিডিয়াতে নারীদের উপস্থিতি সহ ওয়াজিরিস্তানের মতো “অনুন্নত” অঞ্চলে কঠোর সামরিক অভিযানের মাধ্যমে আরও জোরপূর্বক কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে।

RELATED: Pakistan’s Domestic Violence Bill Is an Attack on Islam

সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার জন্য পাকিস্তানের এই ব্যর্থতা আলিজা ইজেটবেগোভিচ (বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার উদ্বোধনী রাষ্ট্রপতি এবং একজন উল্লেখযোগ্য মুসলিম চিন্তাবিদ) ৭০ এর দশকে তার ইসলামিক ঘোষণাপত্রে ভালভাবে ধারণ করেছেন। আমরা পড়ছি, (পৃষ্ঠা ৫৮-৬০)

পাকিস্তানের বিশ বছরের অস্তিত্ব থেকে উপদেশটি স্পষ্টঃ

প্রথমত, একটি ইসলামী ব্যবস্থা এবং মুসলিম সমাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্গঠনের সংগ্রাম শুধুমাত্র একটি দৃঢ় ও সমজাতীয় সংগঠনের নেতৃত্বে পরীক্ষিত এবং সৎ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে।. এটি পশ্চিমা গণতন্ত্রের আস্তানা থেকে কোন ধরণের রাজনৈতিক দল হওয়া উচিত নয়, বরং ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি আন্দোলন, যার সদস্যপদ পেতে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন নৈতিক ও রয়েছে আদর্শিক মানদণ্ড।

দ্বিতীয়ত, আজকে ইসলামী ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম হচ্ছে ইসলামের অপরিহার্য বিষয়গুলির জন্য, যার অর্থ সামাজিক ন্যায়বিচারের মৌলিক উপাদানগুলির সাথে মানুষের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। বর্তমান মুহুর্তে এর গঠন প্রকৃতির গুরুত্ব গৌণ।

তৃতীয়ত, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কাজ প্রাথমিকভাবে পুরুষদের মধ্যে সমতা এবং সমস্ত মুসলমানের ভ্রাতৃত্ব ঘোষণা করা নয়, বরং এই উচ্চ-মনা নীতিগুলি বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করা। ইসলামের জাগরণ, যেখানেই হউক না কেন, একটি ন্যায্য সমাজব্যবস্থার পতাকাকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং এটা স্পষ্ট করে দিতে হবে সংগ্রাম শুরু হবে অজ্ঞতা, অন্যায় ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে এমন একটি যুদ্ধ যা আপস বা প্রত্যাহার করতে জানে না। এটি করতে ব্যর্থ হলে, পতাকাটি ফাঁকাবুলিবাজ এবং সমাজের মিথ্যা ত্রাণকর্তারা তাদের ভণ্ডামিপূর্ণ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য নিয়ে যাবে।

এসব উপদেশ পালনের পথ অনেক বিপদসংকুল। আমরা এখনও পাকিস্তানে এবং এর আন্তর্জাতিক ইসলামের সেবার মিশনে বিশ্বাস করি। এমন কোনো মুসলিম হৃদয় নেই, পাকিস্তান শোনা মাত্র তার হৃদয় স্পন্দিত হয় না, অন্যান্য ভালোবাসার মতো যা ভয় পেতে এবং কাঁপতে জানে। পাকিস্তান আমাদের অনেক বড় আশা, যা পরীক্ষা এবং প্রলোভনে পূর্ণ।

দ্বি-জাতি তত্ত্ব কি একটি ব্যর্থতা? পাকিস্তান কি মুসলমানদের দুর্বল করেছে?

ভারতীয়-মুসলিমরা প্রকৃতপক্ষে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিকে ব্যর্থ বলে বিবেচনা করতে পারে না কারণ এটি আল-ওয়ালা’ ওয়া ‘ল-বারা’ (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইসলামে জোট এবং অস্বীকৃতি) এর একটি ভূ-রাজনৈতিক অবতার মাত্র। . মূলত, অনেক ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে মুসলিম এবং অমুসলিমরা কখনোই একটি “একক জাতি” গঠন করতে পারে না।

কিন্তু ভারতীয়-মুসলিমরা “পাকিস্তানের ব্যর্থতার” অনেক যুক্তি দেয়, তবে প্রাথমিকভাবে দর্শায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সৃষ্টি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঙালি-মুসলমানদের পলায়ন এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করা দৃশ্যত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ব্যর্থতার প্রমাণ। নইলে, মুসলমানরা কি মুসলমানদের সাথে থাকতো?

তবে, প্রথমত, দ্বি-জাতি তত্ত্ব যদি সত্যিকার অর্থেই ব্যর্থ হতো, তাহলে বাঙালি-মুসলিমরা স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করত না, বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি-হিন্দুদের সাথে “পুনরায় যোগদান” করত। অনেক বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ মনে করেন, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংগ্রামের ফসল নয়, বরং একটি বাঙালি-মুসলিম সংগ্রামের ফসল ছিল এবং ৭০-এর দশকে “ইসলামবাদী স্বৈরশাসক” জিয়াউর রহমানের শাসনের পর থেকে বাংলাদেশ ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতিপত্তি রক্ষা করে চলেছে।

দ্বিতীয়ত, বাঙালি-মুসলিমরা যারা পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রগামী ছিল, এটি একটি ধর্মীয় কর্মসূচি হওয়ার কারণে পাকিস্তানের বিরোধিতা করেনি। তারা সংগ্রাম করেছিল কারণ তারা কেন্দ্রীয় শাসনের ধর্মনিরপেক্ষ-আধুনিকতাবাদী ধারণা মেনে নিতে চায়নি। এটি সালমান সাইয়িদ তার খিলাফত স্মরণে (পৃ. ১২৬) ভালভাবে উল্লেখ করেছেন:

পাকিস্তানের ভাঙ্গন যদি কিছু ব্যক্ত করে তা হলো, ওয়েস্টফেলিয়ান রাজনৈতিক মতবাদের ব্যর্থতা। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা ইসলামের জন্য সাথে একত্রিত হওয়া সত্ত্বেও, পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেই আন্দোলনের নিয়ম কামালবাদী নীতির ভিত্তিতে সংগঠিত হয়েছিল, যা ভাষাগত এবং জাতিগত প্রেক্ষিতে জাতীয় ঐক্যের উপর জোর দিয়েছিল। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে অবনমিত করার প্রচেষ্টা, ‘মার্শাল রেস’ ঘিরে ঔপনিবেশিক জাতিগত নীতি গ্রহণ এবং নাগরিকত্বের উপর বিধিনিষেধ আরোপ যা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদেরও পাকিস্তানের নাগরিক হতে বাধা দেয়। যা দ্বারা স্পষ্ট হয় শুধু “মুসলমান” পরিচয় দুটি অংশকে সংঘবদ্ধ করার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না।বরং এই পরিচয় পরিত্যাগ করা হয়েছিল ‘আর্থ-রাজনৈতিক সংহতির’ জন্য প্রয়োজনীয় ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত একতাত্বের উপর জোর দিয়ে একটি ওয়েস্টফালিয়ান-শৈলীর জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে। পাকিস্তানের বিচ্ছেদকে একটি মুসলিম রাজনৈতিক পরিচয়ের অক্ষমতার উদাহরণের পরিবর্তে, জাতি গঠনের এই ওয়েস্টফালিয়ান অনুপ্রাণিত কেমালিস্ট মডেলের আরেকটি ব্যর্থতা হিসেবে দেখা উচিত।

তাই বাঙালি-মুসলিমরা (বা বাংলাদেশিরা) পাকিস্তানকে দ্বি-জাতি তত্ত্ব “চাপিয়ে” দেবার কারণে আলাদা হয়নি বরং পাকিস্তান নিজেই তার উদার-আধুনিকতাবাদী নেতাদের অনুকরণ করে দ্বি-জাতি তত্ত্বের এজেন্ডা ত্যাগ করেছে।

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের সৃষ্টি ছাড়াও ভারতীয়-মুসলিমদের অন্য ক্লাসিক সমালোচনা হলো যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি মুসলমানদের “দুর্বল” করেছে।

এর কিছু সত্যতা আছে, ক্রিস্টোফ জাফরেলট (দক্ষিণ এশিয়ার একজন নেতৃস্থানীয় পশ্চিমা শিক্ষাবিদ) লিখেছেন যে কীভাবে মুঘল ক্ষমতার পুরানো কেন্দ্রগুলি যেখান মুসলিম অভিজাত্যের বিকাশ হয়েছিল (যেমন ভারতের উত্তর প্রদেশ, এখন শাসন করছে হিন্দুত্ববাদী সন্ন্যাসী যোগী আদিত্যনাথ) সেখানে থাকা মুসলমানদের তাদের “রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব” ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।

এখন বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করুনঃ

যদি ভারতের ২৫০-২৮০ মিলিয়ন মুসলমানদের “এলিটরা” ভারতীয় জাতীয়তাবাদ দ্বারা কলুষিত হতে পারে, তাহলে কে বলতে পারে যে অতিরিক্ত ৩৫০ মিলিয়ন মুসলমানদের (পাকিস্তান ও বাংলাদেশের) পরিস্থিতি শেষে একই হবে না?

RELATED: Will the Congress Party and Its Secularism Save the Muslims of India?

দেশ ভাগ না হলে, আজকের পাকিস্তানের (এবং বাংলাদেশের) মুসলমানদের একটি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থাকত না (যা হতো হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ)। আজ তারা যে ক্ষমতা ভোগ করে ভারতীয়-মুসলিমরা কি তা পারে?

৬০০ মিলিয়ন মুসলমান কি সত্যিই, ১.১ বিলিয়ন হিন্দুর বিপরীতে বর্তমান সংখ্যার (২৫০-২৮০ মিলিয়ন) চেয়ে “বেশি শক্তিশালী” হবে?

আমরা তর্ক খাতিরে বলতে পারি, একটি “অবিভক্ত ভারতে” আরও মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য থাকত, কিন্তু বর্তমানের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীরের কী অবস্থা? কাশ্মীর হতে ব্যতিক্রম কিছু হতো?

RELATED: Kashmir: The Forgotten Struggle and the Terror of Hindu Nationalism

বলা যুক্তিযুক্ত হবে দেশ ভাগ অন্তত কয়েক শত মিলিয়ন মুসলমানকে হিন্দুদের সমাজে উপস্থিতি এবং বিশেষ করে হিন্দু আধিপত্য থেকে রক্ষা করেছে।.

সুতরাং, আমাদের মুলবক্তব্য হলোঃ

বিভাজনটি ছিল মৌলিকভাবে কল্যাণকর এবং সম্ভবত প্রয়োজনীয়। পাকিস্তান তার উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, এর উদার-ধর্মনিরপেক্ষ-আধুনিক নেতৃস্থানীয়দের কারণে।.

MuslimSkeptic Needs Your Support!
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments