
এই লেখার শিরোনাম একটু অতিরঞ্জিত বা প্রলুব্ধকর লাগতে পারে, বাস্তবেও তাই। আসল কথা হচ্ছে এটা একধরণের বৃদ্ধিবৃত্তিক অলসতাজনিত সস্তা অভিযোগ যেটা ইসলামের সমালোচকরা ইসলামের সমালোচনা করার জন্য ব্যবহার করে, ওদের দাবি হচ্ছেঃ
- মুসলিমদের মধ্যে থাকা ‘সমস্ত কল্যাণ’ ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত না; এবং
- মুসলিমদের মধ্যে থাকা ‘সমস্ত মন্দ’ ইসলামের কারণেই এসেছে।
অবশ্যই এই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একদমই ভিন্ন হবে।
আমরা শুরুতেই অনুসন্ধান করবো যে আদৌও কোন ‘স্বর্ণযুগ’ বলে কিছু ছিলো কিনা, এবং বাস্তবে কেনো এই পুরো বিষয়টি সমস্যাজনক।
স্বর্ণযুগ ও ইউরোপকেন্দ্রিক বস্তুবাদী ইতিহাস
‘স্বর্ণযুগ’ পরিভাষাটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এটার মাধ্যমে ইতিহাস রচিত হয়।
স্বর্ণযুগ বলে যদি ধর্তব্য কিছুই থেকেই থাকে তাহলে এটাও স্বীকার করতে হবে যে সেই যুগের আগের যুগ অত ভালো ছিলোনা আর সেই যুগের পরের সময়টা শুধু মন্দই না বরং খানিকটা অবক্ষয় ও ক্ষয়িষ্ণুতারও ইঙ্গিত।
সবচেয়ে খারাপ খবর হচ্ছে স্বর্ণযুগকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার মাপকাঠিতে যাচাই করা হয়। আধুনিক পশ্চিমা মানদন্ড ব্যবহার করে
মুসলিমদের জন্য সম্ভবত রাসুলুল্লাহ ﷺ এর সময় থেকে খুলাফায়ে রাশেদিন পর্যন্ত সময়কে স্বর্ণযুগ আখ্যা দেয়া বেশি যুক্তিযুক্ত। কেউ কেউ চাইলে উমাইয়্যাহদের শুরু দিকের বিজয়গুলোকেও যুক্ত করতে পারে। মূলকথা কথা,এমনটা বললে সেটা সম্পুর্ণ ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে হবে,ইউরোসেন্ট্রিক কোনো বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সূচকে না।
অবশ্যই, গনিত, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি শাস্ত্রে অবদান রাখা ব্যক্তিবর্গকে প্রশংসায় দোষের কিছু নেই। তবে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিজয়ী সমাজ কখনো গনিতবিদ বা পদার্থবিদ দ্বারা পূর্ণ থাকেনা বা সেইসব দার্শনিকদের দ্বারাও যারা গ্রিক চিন্তায় মোহগ্রস্ত।
সম্পর্কিত: কেন আমরা ইসলামের উপর বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করব?
উপরে যেমনটা বর্ণিত হলো, আব্বাসি যুগের শেষভাগকে স্বর্ণযুগ আখ্যা দেয়াটা যে শুধু রাসুলুল্লাহ ﷺ এর সময়কালকে নিন্দা করা শুধু তাই না বরং সেই স্বর্ণযুগের পরবর্তী অনুসরণ করা সমস্ত কিছুকে অধঃপতিত জ্ঞান করা।
তাহলে ভেবে দেখুন এমন ইতিহাস রচনার সুফল কারা ভোগ করছে?
অবশ্যই লিবারেল সংস্কারকরা।
প্রাচ্যবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত এসব লিবারেল সংস্কারকরা বলে যেহেতু তারা একটি অবক্ষয়ের যুগে ছিলো অতএব উন্নতির একমাত্র পথ হচ্ছে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী দের অনুসরণ করা। মোটকথা,যার জন্য(তথাকথিত স্বর্ণযুগে) মুসলিমরা স্বীকৃত ছিলো সেটাই ছিলো তাদের একমাত্র হাতিয়ার, বিকল্প – বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সূচকে যদি স্বর্ণযুগকে বিচার করা হয়, তাহলে লিবারেল সংস্কারকরা (যারা কিনা ইউরোপের সামরিক শক্তিকে প্রশংসা ও একইসাথে সমীহ করেছিল) একদম পুরোপুরি ভুলও কিছু বলেনি।
আমেরিকার ফিলিস্তিনী খ্রিস্টান একাডেমিক জোসেফ মাসাদ তার সংকলিত ইসলাম ও প্রাচ্যভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থায় লিখেছেন,
প্রাচ্যবাদী বিচার বিশ্লেষণ ধারা প্রভাবিত হয়ে, অটোমানদের শাসনামলে আরব সংস্কৃতি অবনতি হয়ে এক অবক্ষয়ের যুগে প্রবেশ করে, উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বেশিরভাগ আরব লেখকই তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিন্যাস, প্রথারীতি এবং তাদের নিজেদের ঐতিহ্যের দর্শনগুলো থেকে ভিন্ন কিছুর মুখোমুখি হয়ে পরাভূত হয়। এমনকি “ইসলাম” নিজেও যেন, সংক্ষেপে বললে,আরব সভ্যতার জন্য একটি পীড়া ছিলো এমন মত বা দর্শন তৈরী হয়। সমস্যার মূল চিহ্নিত করতে প্রাচ্যীয় বিচার বিশ্লেষণ, পশ্চাৎপদতা, নৈতিক অবনতি ইত্যাদি ধারনার পুনরাবৃত্তি করা হয়। যেগুলো বেশিরভাগই নাকি কয়েক শতকের অটোমান শাসন থেকে উদ্ভুত। অটোমান শাসনকে বড়োজোর সাময়িক স্থিতিশীল বা আরবদের বিষয়াদি ও মুসলিম বিষয়াদির জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অটোমান শাসনকে নিয়ে এমন বুঝ অটোমান বিরোধী আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
ইতিহাসের এমন দর্শন মুসলিম বিশ্বের সকল লিবারেল সংস্কারকদের আক্রান্ত করে। তারা এই ধারণাকে সাদরে গ্রহণ করে যে মুসলিমদের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার যুগই স্বর্ণযুগ ছিলো। আর এখন যেহেতু ঔপনিবেশিক ইউরোপ এই ক্ষেত্রগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আর তাই তাদের জীবনযাত্রাকে(লিবারেলিজম, সেকুলারিজম) অনুসরণ করার চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে?
প্রফেসর ড. জামাল মালিক(একজন পাকিস্তানি একাডেমিক যিনি জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান) স্বর্ণযুগের ধারণা ও ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের মধ্যে সম্পর্ককে তার দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম- একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৪-৫: বইয়ে তুলে ধরেছেন।
এই কল্পচিত্র সাধারণভাবেই এমন একটি ইসলামি স্বর্ণযুগ কল্পনা করায় যা কি না প্রথমে মৌলবাদী ইসলাম, তারপরে পুনর্জাগরণ (স্বর্ণযুগ) এবং সবশেষে পতনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। সেইসাথে এটি দীর্ঘস্থায়ী সেসব প্রাচ্যবাদী ধারণাগুলোর সাথে সংযুক্ত যেগুলো এই জাতীয় ধারণার উপর স্থাপিত যে, ক্রমবর্ধমান ইসলামি সংস্কৃতি ১২৫৮ সালের মঙ্গল আক্রমণ দ্বারা মুছে যায়, আর তারপরে এক দীর্ঘ অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে ও ১৭৫০ সালে পূর্ণতা পায়, যখন এনলাইটেনমেন্টের আলোয় ইউরোপ আলোকিত হয়েছিলো,প্রাচ্যে তখন বর্বরতা ও জুলুম রাজত্ব করে। এই উল্টোচিত্র আরো পাকাপোক্ত হয়েছিলো যখন উনিশ শতকের ইসলামি পুনর্জাগরণের মাধ্যমে ঠিক যেন ঔপনিবেশিক চুম্বন রুপকথার রাজকন্যার ন্যায় ঘুমিয়ে থাকা (সেকুলার,লিবারেলিজম)কে জাগিয়ে তুলেছিল। এই কৌশলী ও প্রসিদ্ধ চিত্রায়ন বা বয়ান দুর্ভাগ্যবশত অনেক মুসলিমরাও বিশ্বাস করে। অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ছিলো প্রাচ্যবাদী ধ্যানধারণার উপর, এবং এটাকেই তারা ইতিহাস রচনার মাধ্যমে অন্বেষণ করেছিলো, বিভিন্ন প্রাচ্যবাদী পাঠ তৈরীর মাধ্যমে।
এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই, যেমনটা এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন, ইসলামি স্বর্ণযুগ আসলে প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্টদের প্রোডাক্ট।
“স্বর্ণযুগে”র পরে কিছু স্বর্ণ?
আমরা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি যে আমরা “স্বর্ণযুগে”র ধারণা বিপক্ষে। এটা আসলে ইতিহাসকে ইউরোকেন্দ্রীক চিন্তা দিয়ে ব্যাখা করা এবং এই ফাঁদের মাধ্যমে মুসলিমদেরকে ঘায়েল করার প্রয়াস।
এখানেই কিন্তু শেষ না এখনো অনেকটা বাকি,
স্বর্ণযুগের ধারনাকে তাদের বক্তব্য ও মানদণ্ড দিয়ে ভুল প্রমাণ করা যায়।
“স্বর্ণযুগ বলতে মূলত নবম শতক থেকে- যখন আব্বাসী খলিফা আল মামুন বাইতুল হিকমাহ নির্মাণ করেন এবং ভাষান্তর বা অনুবাদ বিপ্লব শুরু করেন(বেশিরভাগই গ্রিক রচনাবলি) – ১২৫৮ পর্যন্ত অর্থাৎ (হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণ পর্যন্ত) সময়কে বোঝায়।
কিন্তু বিষয়টি এত সহজ না।
ইলিয়াস মুহান্নার (মধ্য ও আধুনিক যুগের ইসলামের ইতিহাসে পাণ্ডিত্যপূর্ণ এক আমেরিকান একাডেমিক) ২০১৭ তে“দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন অ্যা বুক” শিরোনামে একটি বই বের হয়।
এটা মূলত আল নুহাইরীর পাঠ, ১৪ শতকের একজন মিশরীয় মুসলিম সরকারি কর্মকর্তা যিনি এক বিশাল ইসলামি বিশ্বকোষ সংকলন করেন যেখান ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে শুরু করে জ্যোতির্বিদ্যা, প্রানীবিদ্যা ইত্যাদি সবকিছুই লিপিবদ্ধ ছিলো।
মুহান্না দেখিয়েছেন যে মিশর ও সিরিয়ায় মামলুকদের সময়কালে এমন বিশ্বকোষনির্ভরতা খুবই স্বাভাবিক ছিলো। (তাহলে কিসের “অবক্ষয়”!).
কিন্তু প্রচলিত বয়ান এটা যে, মুসলিমরা জ্ঞান বিজ্ঞান রক্ষা ও সংরক্ষণ করতে বিশ্বকোষনির্ভর হয়েছিল আসন্ন মঙ্গল আক্রমণের পরপরই। মুহান্না ঠিক এটাকেই খন্ডন করেছেন।
উপরোল্লিখিত বইয়ের ১৬-১৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,
মিশর ও সিরিয়ায় মঙ্গলদের বিজয়ের পরবর্তী সময়কালে এনসাইক্লোপিডিয়া কেন্দ্রিক সাহিত্যের উত্থানের কারণ হিসেবে ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন, মামলুক সংকলকরা ভয়ে ছিলো লাইব্রেরিগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে সকল জ্ঞান হারিয়ে যাবে। এই বিপদজনক ঘনঘটার মাধ্যমে সৃষ্ট আশংকাই মূলত আল নুহাইরী এবং তার সমসাময়িকদের কাজে পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। যারা বিভিন্ন ম্যানুয়াল,অভিধান,পুস্তিকা আকারে স্বর্ণযুগের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার অর্জনকে সংরক্ষণ করেছিলো।
(…)
মঙ্গলদের বিজয়গুলো নিকট প্রাচ্যে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছিলো ঠিকই কিন্তু বই প্রোডাকশনে এমন বিশাল কোনো সাংস্কৃতিক আঘাত করেনি। বাগদাদের লাইব্রেরিগুলোকে টাইগ্রিস নদীতে ভাসানোর বিখ্যাত বর্ণনাটি মূলধারায় আবির্ভাব ঘটে ইতিহাস রচনার শেষদিকটাতে। স্থানীয় ও তৎকালীন কোনো উৎসতেও এরকম কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায় না। যদিও বা বাগদাদ আব্বাসী সাম্রাজ্যের ছিলো,কিন্তু বাগদাদ বহু আগেই হারুন অর রশিদের সময়কার সাংস্কৃতিক জৌলুশ হারিয়েছিলো। মাইকেল কুপারসন বাগদাদ সম্পর্কিত সেইসব লেখালেখি ও প্রচলিত বর্ণনা পরীক্ষা করে বলেছেন, মঙ্গলদের আক্রমণের বহু আগেই এই নগরীটি কার্যত অচল হয়ে পড়ে। আন্দালুসিয়ান পর্যটক ইবনে জুবায়ের হালাকু খানের আগমনের প্রায় ৭৫ বছর পূর্বে বাগদাদ সফর করেন এবং একে একটি ‘ ভঙ্গুর বিলুপ্ত শিবির’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
সংক্ষেপেঃ
মঙ্গলদের আক্রমণের কারণে মুসলিমদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে তেমন দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রভাব পড়েনি।
সুতরাং, যদি “স্বর্ণযুগ” মিথের ভিত্তিগুলিকে যদি একপেশে বা বায়াসড বলা হয়, তাহলে আমাদের উচিত হবে ১২৫৮ সালের পরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাফল্যগুলোকে সামনে আনা।
সম্পর্কিত:[WATCH] ইসলামে বিজ্ঞানের স্থান কি?
অবশ্যই
উদাহরণস্বরুপ, জর্জ সালিবা ( আমেরিকার লেবানিজ ক্রিশ্চিয়ান একজন একাডেমিক) বলেছেন জ্যোতির্বিদ্যার স্বর্ণযুগ শুধু ১২৫৮ এর পরে না বরং উল্টো হালাকু খানের বদৌলতেই এসেছে। তিনি ১২৫৯ সালে মারাঘি অবজারভেটরির(বর্তমানে ইরানে) নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন যেখানে অনেক জ্যোতির্বিদরা কাজ করতো।
সালিবা আরো বলেন, ইবনে আল শাতির,১৪ শতকের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ যিনি দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের জন্য সুপরিচিত, যার চিত্রাঙ্কন ও মডেল কয়েক শতাব্দী পরে আসা কোপার্নিকাসের অনুরুপ।
গণিতশাস্ত্রে ছিলো ইবনে হামজা আল মাগরিবী ১৬ শতকে আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং অটোমানদের অধীনে কাজ করেন এবং নেপিয়ারের কয়েক দশক আগেই লগারিদমের ধারণা আবিষ্কার করেন।
দার্শনিক ধর্মতত্ত্ব বা কালামশাস্ত্রে রবার্ট উইসনভস্কি সহ অনেক একাডেমিক তথাকথিত স্বর্ণযুগের পরে ইসলামি জ্ঞানচর্চার উচ্চতাকে জোরালোভাবে ব্যক্ত করেছেন।
উইনসভস্কি বলেন, স্বর্ণযুগ পরবর্তী সময়ে ইসলামি জ্ঞানচর্চার ইতিহাসের স্বচ্ছ চিত্র না পাওয়ার কারণ হচ্ছে অসংখ্য পান্ডুলিপি থেকে যায় যেগুলো পর্যবেক্ষণ হয়নি।
মুজাফফর ইকবাল তার বই দ্য মেকিং অফ ইসলামিক সায়েন্সের ১৪৪-১৪৬ পৃষ্ঠায় বলেন,
ঠিক এখনই বা একটা নির্দিষ্ট সময়ে মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখাকে আমরা মৃত ঘোষণা করতে পারিনা। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রকৃতি বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন শাখার যে তথ্য উপাত্তগুলো পাওয়া সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন(এটা মাথায় রেখে যে সকল পান্ডুলিপি বা প্রমাণাদি পাওয়া অসম্ভব), সেই সাথে প্রতিটি শাখার সফলতার ওঠানামাকে, এরপরে একটা সময়কালকে নির্দিষ্ট করা যাতে সেই শাখার পতনকাল নির্ধারণ করা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই কাজটি ভাষাতত্ত্ব ও বিজ্ঞানে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন ইতিহাসবিদদের জন্য।
তা যদি করাও হয়,পর্যাপ্ত পরিমাণ পান্ডুলিপি যাচাই বাছাই করার আগ পর্যন্ত সেটাও সাময়িক। কিং যেমনটা দেখিয়েছেন, এখনো পর্যন্ত অষ্টম শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ১০০০ মুসলিম বিজ্ঞানীদের তথ্য আমরা জানি। এর বাইরেও হাজার জন আছেন যাদের ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই, অথবা আমরা শুধু তাদের নাম আর কাজের নাম জানি।
শুধু ইরানেই ২০০,০০০ র বেশি পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। যার প্রায় ১৫০,০০০ই তালিকাভুক্ত নেই। ১৯৯৪ সালে, কিং লিখেছেন, “মানচিত্র নিয়ে আমার গবেষণা চলাকালে, ইরানের কোমে আয়াতুল্লাহ আল উযমা মারাশি নাজাফির পাবলিক লাইব্রেরিতে থাকা ৮০০০ পান্ডুলিপির ২১ টি তালিকাখন্ডের সুবৃহৎ সূচিপত্রটিও আমার ডেস্কে ছিলো। সেখানে গনিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে প্রায় ৪০০র ও বেশি বইয়ের নাম ছিলো, সাথে এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এমনও কিছু ছিলো। (কিং ১৯৯৯, ৪, ন. ৪ ও ৫) কিং তার বইয়ে প্রায় ৯০০২ টি নথি, ৮০ টির বেশি পান্ডুলিপি এবং ৩৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থপঞ্জি’র উল্লেখ করেছেন।
ভিন্ন ভাষাভাষী মুসলিমদের ব্যবহৃত পান্ডুলিপি বাদেই শুধু এক আরবি ভাষায়ই ১০ লক্ষাধিক পান্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। একারণে, বাস্তবতার সঠিক চিত্রায়ন ও বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপন এক প্রকার অসম্ভবই বটে। যাই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে তথাকথিত “স্বর্ণযুগ” পরবর্তী সময়ে কিছু ঘটেছিলো।
সুতরাং, আমরা দেখলাম স্বর্ণযুগের ধারণাটি প্রাচ্যবাদীদের তৈরি ইউরোকেন্দ্রীক ও আধুনিক ধ্যানধারণাপূর্ণ।
আমরা এটাও দেখলাম যে, কেউ মেনে নিলেও এমন স্বর্ণযুগের পরে কি ঘটেছিলো সেটা না জেনে কথা বলা কেন অনুচিত। বিশেষকরে এমন একটা সময় যখন পশ্চিমা একাডেমিকরা নিজেরাই সর্বত্র সমাদৃত ‘অবক্ষয়ে’র দাবিকে রদ করছে ও ‘অবক্ষয়’ আদৌও ছিলো বলে কোনো প্রমাণ ও পাওয়া যায় না।
কিছু বিষয় পরিষ্কার করে রাখতে চাই,
আমরা মুসলিমরা জানি যে সর্বোত্তম যুগ হচ্ছে নবী ﷺ ও তাঁর সাহাবিদের যুগে, তারপরে, তার পরের প্রজন্ম ও তার পরের প্রজন্ম। বস্তুবাদীদের কোনো সুযোগই নেই আমাদেরকে অন্যথায় বোঝানোর।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল ﷺ বলেছেন, ‘মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো হলো আমার যুগের লোকজন। এরপর তাদের পরবর্তী লোকজন এবং তারপর ওদের পরবর্তী লোকজন।
সম্পর্কিতঃ মুসলিমদের জন্য প্রকৃতি বিজ্ঞান কতটুকু যৌক্তিক? শাইখ মুহাম্মদ আওয়ামা ব্যাখা করেছেন