মানবাধিকার: মুসলিমদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার এক মোক্ষম হাতিয়ার

মুসলিমদের চিন্তা কাঠামোর উপর তথাকথিত “সর্বজনীন মানবাধিকার”-এর যে সুবিশাল প্রভাব, অধিকাংশ মুসলিমই সে ব্যাপারে সচেতন নয়। এই সেক্যুলার মানবাধিকার– মুসলিমদেরকে একইসাথে ধর্ম নিরপেক্ষ ও নিয়ন্ত্রণ করতে ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি সাম্প্রতিক নিবন্ধে, অধ্যাপক ‘আরিয়া নাকিসা’ উল্লেখ করেন, ঔপনিবেশিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত, উদারতাবাদ (Liberalism) “মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি স্বতন্ত্র নীতিমালা” প্রস্তুত করেছে।”[1]

ঔপনিবেশিক যুগে- পশ্চিমারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার ও দখলদারিত্ব কায়েমের জন্য, “সভ্য করার মিশন” নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিলো, যার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিলো- বিশ্বের বিভিন্ন ভূখন্ড দখল করে, সেখানকার অধিবাসীদেরকে ‘সভ্য’ করার নামে পশ্চিমা উদারনৈতিক মূল্যবোধ (Western Liberal Values) ‘শিক্ষা’ দেওয়া। পশ্চিমারা, এই ‘সভ্যকরণ’ নামক প্রকল্পের মাধ্যমেই- অষ্ট্রেলিয়ান এবরোজিন, আমেরিকান ইন্ডিয়ানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মূল অধিবাসীদেরকে জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করার মিশন শুরু করেছিলো। অথচ আজও আমাদেরকে শেখানো হয়- ইউরোপিয়ানরা ছিলো “উন্নত-সভ্য” জাতি এবং তাদের দ্বারা বিজিতরা ছিলো “অসভ্য-বর্বর”। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমরাও সেই শিক্ষা অকপটে গিলে খাই!

পশ্চিমা ঔপনিবেশিকরা, মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য “মুসলিম পলিসি” নামক পৃথক নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলো। “মানবাধিকার”, “ধর্মীয় সংস্কার”, “সন্ত্রাসবাদ দমন” ইত্যাদি বিভিন্ন ছদ্মনামের আড়ালে, আজও এই পলিসি বিদ্যমান রয়েছে। আমরা প্রায়ই ধারণা করি- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশগুলো (Colonies) বন্ধের মাধ্যমে, মুসলিম ভূখন্ডে পশ্চিমা দখলদারিত্বের সমাপ্তি ঘটেছে। আসলে, এটা ভয়াবহ রকমের ভুল ধারণা।

সাম্রাজ্যবাদের নব্যরূপ

ঔপনিবেশিক আমলে, ‘পশ্চিমা দখলদারিত্ব’ ছিলো সুস্পষ্ট ও সরাসরি। দখলদার দেশের সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ উপস্তিতিতে আধিপত্য কায়েম করা হতো; জনগণ, দখলদারদের সরাসরি দেখতে পেতো এবং স্পষ্ট বুঝতে পারতো কারা তাদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা প্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম ভূখন্ড দখল করে, সেখানকার অধিবাসীদের উপর আধিপত্য কায়েম করেছিলো। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিউপনিবেশায়ন ঘটে এবং তথাকথিত ‘স্বাধীনতা’ দেয়ার নামে ঔপনিবেশিক ভূখন্ডসমূহকে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত করা হয়।

এর থেকেই, জনগণের মাঝে এই ভুল ধারণা জন্ম নেয় যে, “আমরা আর সাম্রাজ্যবাদীদের শাসনাধীনে নেই”। আসলে, ৩০০ বছর ব্যাপী উপনিবেশসমূহের উপর সাম্রাজ্যবাদীদের যে নিয়ন্ত্রণ ছিলো, সাবেক উপনিবেশগুলো থেকে তা শেষ হয়ে যায়নি। প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগ হয়তো শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের নতুন একটি পদ্ধতি উন্মক্ত হয়েছে; আরও অধিকতর সূক্ষ্ম, প্রতারণাপূর্ণ, পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

RELATED: কাতার: মুসলিমদের মধ্যে উদারতাবাদকে ছড়িয়ে দিতে যেভাবে বিশ্বকাপকে ব্যবহার করা হয়েছে

উদারনৈতিক ভাবাদর্শ (Liberal Ideology), মানুষের সামনে তার এমন একটি কৃত্রিম ভাবমূর্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, মনে হয় যেনো- সাম্রাজ্যবাদ, স্বেচ্ছাচারিতা, জাতিকেন্দ্রিকতা ও বর্ণবাদের “বিরুদ্ধে” এর অবস্থান। কিন্তু, লিবারেল ভাবাদর্শ প্রকৃতপক্ষে এসবকেই প্রচার (Promote) করে; বিশেষ করে সাবেক উপনিবেশগুলোতে, যেখানকার স্থানীয় জনগণ, তাদের নিজস্ব বিষয়সমূহ পরিচালনা করতে ‘অপ্রস্তুত’ ও ‘অপারগ’ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা পুরোপুরি ‘সভ্য’ হয়ে উঠছে (অর্থাৎ লিবারেল মূল্যবোধসমূহ পুরোপুরি গ্রহন করছে), ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবে না! এইভাবে, যতক্ষণ না তারা ‘মধ্যযুগীয়’ পদ্ধতি বাদ দিয়ে, ‘আধুনিক’ পদ্ধতির কাছে নিজেদেরকে পুরোপুরি সমর্পন করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে স্বেচ্ছাচার, স্বৈরতন্ত্র কিংবা সামরিক শাসনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে পশ্চিমা শাসনের অধীনস্থ করে রাখা হয়। এই কারনেই মুসলিম বিশ্বে একনায়কদের ছড়াছড়ি দেখা যায়।

বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া

জাতিসংঘ এমন একটি মানব-হিতৈষী প্রকল্প হিসেবে নিজেকে প্রচার করে থাকে, যে কিনা সারা বিশ্বের প্রগতি ও উন্নতির কাজে নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে নিয়োজিত রেখেছে। ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ’, ‘ক্ষুধা নির্মূল’, ‘পৃথিবীর পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষা’ ইত্যাদি ভাবাবেগপূর্ণ কথাবার্তার দ্বারা জাতিসংঘ মানুষের মনে নিজের এমন একটি প্রতিচ্ছবি (image) তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যেনো এটি একটি অরাজনৈতিক ও মহৎ সংগঠন, যেটির একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীবাসীর কল্যাণ।

কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে, পশ্চিমা পরাশক্তিদের দ্বারা নির্মিত একটি বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, যেটির একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ সাবেক উপনিবেশগুলোকে এমন একটি জাতিতাত্ত্বিক সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসা, যার মাধ্যমে দূর্বলদের উপর সবলদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।

RELATED: উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনের মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ

১ম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভের পর পশ্চিমা মিত্র শক্তিলীগ অব নেশনস গঠন করে, যেটি ছিলো জাতিসংঘ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ। এটি গঠনের পেছনে আসল উদ্দেশ্য ছিলো, একটি নূতন বিশ্ব ব্যবস্থার (New World Order) প্রবর্তন করা, যার মাধ্যমে প্রাচীন সাম্রাজ্যসমূহকে (যেমন : অটোমান সাম্রাজ্য, জার্মান সাম্রাজ্য, রাশিয়ান সাম্রাজ্য) খন্ড খন্ড জাতিরাষ্ট্রসমূহে বিভক্ত করা হবে; আর এই বিভক্ত রাষ্ট্রসমূহ, ‘সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা’-র মধ্যে থেকে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকবে। এমনকি, অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ১ম বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোই হয়েছিলো অটোমান সাম্রাজ্য ও জার্মান সাম্রাজ্যকে বিভাজনের পথ সুগম করার জন্য, যার মাধ্যমে পরবর্তীকালে একটি নূতন বিশ্ব ব্যবস্থার বিজয়ের পথ সুগম হবে।

লীগ অব নেশনস ব্যর্থ হয়েছিলো। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ের ফলে, ১৯৪৫ সালে মিত্র শক্তি জাতিসংঘ গঠন করতে সমর্থ হয়। তখন থেকেই জতিসংঘকে এমনভাবে সংগঠিত করা হয়েছে যে, এটি সর্বদা পশ্চিমা পরাশক্তিদের স্বার্থ পূরণে কাজ করে গেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উচ্চতর অবস্থানে থাকা পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ সর্বদাই জাতিসংঘে বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে। এছাড়াও, জাতিসংঘের সদর দপ্তর অবস্থিত, নিউইয়র্কে।[2]

মানবাধিকার – মুসলিমদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার এক মোক্ষম হাতিয়ার

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার স্বল্পকাল পরেই, “সর্বজনীন মানবাধিকার নীতি” ঘোষনা করা হয়। উদারনৈতিক-ধর্মনিরপেক্ষ (Liberal-Secular) ভাবাদর্শ অনুসারে, মানবাধিকার (Human Rights) প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ও “প্রগতিশীল”। সেক্যুলার কাঠামোতে, একদা যেটাকে জঘন্য ও নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, এখন হয়তো সেটাকেই “স্বাভাবিক” ও “মানবাধিকার” হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ : সর্বজনীন মানবাধিকার নীতি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির উপর ভিত্তি করে, পশ্চিমা অনেক দেশে LGBT-র মত কুৎসিত ও জঘন্য ব্যাপারকে এখন মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে।

মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে এরূপ শর্ত দেয়া হয় যে– “আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অংশ হতে হলে, সংবিধান ও আইনি কাঠামোকে ক্রমান্বয়ে জাতিসংঘ প্রণীত আইনসমূহের সাথে সমন্বয় করতে হবে।” [3] আর এ শর্তে রাজি করানোর জন্য, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে NGO (Non-Governmental Organizations) ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সিস্টেমের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করা হয়। যেসকল রাষ্ট্রসমূহ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক নীতিসমূহ গ্রহণ করতে অসম্মতি জানায়, পশ্চিমারা সেসব ‘অবাধ্য’ রাষ্ট্রসমূহকে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে বাধা হিসেবে দেখে; আর এ বাধা দূর করতে তারা তাদের উপর যে কোন ধরণের বলপ্রয়োগ করতে পারে। যেমনটা ‘নাকিসা’ তাঁর আর্টিকেলে লিখেছেন :

“অসুবিধায় ফেলার হুমকি কিংবা সুবিধা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ অ-পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকে- জাতিসংঘের ক্রমবিকশিত নীতিসমূহকে সমর্থন করা, পশ্চিমা এনজিও-সমূহকে সেসব (অ-পশ্চিমা) রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কাজ করার স্বাধীনতা ও সহায়তা প্রদান করা এবং তাদের দেয়া পরামর্শসমূহকে বাস্তবায়ন করা… ইত্যাদি দাবিসমূহ আদায় করে থাকে।” অনেক স্কলারের মতেই- আধুনিক বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা, উপনিবেশবাদেরই এক বিশেষ রূপ; বিশেষত, মুসলিমদের ক্ষেত্রে একথা আরও অধিকতর প্রযোজ্য।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এড়াতে, IMF-থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য ও বিভিন্ন প্রযুক্তি আমদানির চাহিদা মেটাতে– মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক মহল থেকে আসা চাপের কাছে নতি স্বীকার করে। এজন্যই দেখা যাচ্ছে, কতিপয় ‘রক্ষণশীল’ আরব দেশ নিজেদের সংস্কৃতিকে পশ্চিমা কুফরী সভ্যতার রঙে রাঙাতে উঠে পড়ে লেগেছে। উদাহরণস্বরূপ : সৌদির ভিশন-২০৩০ এর কথা উল্লেখ করা যায়। পশ্চিমারা সেসব স্বৈরাচারী শাসকবর্গকে ক্ষমতায় দেখতে চায়, যারা কিনা প্রতিনিয়ত তাদের জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে, তাদের সমাজব্যবস্থাকে উদারনীতিকরণ (Liberalize) করা অব্যাহত রাখবে এবং পশ্চিমা কুফর সংস্কৃতি (যেমন : মানবাধিকার)-এর প্রভাব বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখবে।

RELATED: পশ্চিমা এনজিও-গুলো যেভাবে সাহায্য করার ছদ্মবেশে, ইসলামকে আক্রমণ করে এবং মুসলিম সমাজব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে।

পশ্চিমা কুফফার ও মুসলিম ভূখন্ডে বসবাসকারী তাদের দোসররা, এমন ইসলাম তৈরি করতে চায়, যেটা কিনা তার চিরায়ত সুমহান বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী “অসাধু ও দুর্বৃত্তদের জন্য হুমকিস্বরূপ” না হয়ে, জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রভাবশালীদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ইসলামকে শিথীলকরণ ও বিকৃতকরণ করার এই ঘৃণ্য চক্রান্ত সম্পর্কে সকল মুসলিমকে সচেতন হতে হবে।

Notes

[1] https://compass.onlinelibrary.wiley.com/doi/full/10.1111/hic3.12748

[2] Nakissa, A. (2022). Liberalism’s distinctive policy for governing Muslim populations: Human rights, religious reform, and counter-terrorism from the colonial era until the present. History Compass, 20(9), e12748. https://doi.org/10.1111/hic3.12748

[3] Ibid.

MuslimSkeptic Needs Your Support!
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments