সাহওয়া আন্দোলন : সৌদি রাজতন্ত্র ও আলেমদের সম্পর্কে এর প্রভাব

Sahwa figures imprisoned by Saudi authorities
Prominent Sahwa figures imprisoned by Saudi authorities

২ আগস্ট ১৯৯০, সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত আক্রমণ বৈশ্বিক উত্তেজনার জন্ম দেয়। সম্ভাব্য ইরাকি আক্রমণের ভয়ে সৌদি সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের আমন্ত্রন জানায় নিজেদের সীমান্ত সুরক্ষার জন্য। সৌদি আরব এই প্রথমবারের মতো কোন অমুসলিম শক্তিকে হারামাইনের ভূখন্ডে প্রবেশের অনুমতি দেয়। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় একটি নতুন গ্রুপ গড়ে উঠে, যারা সাহওয়া নামে পরিচিত।

সাহওয়া আন্দোলনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল হাজার হাজার তরুণকে মার্কিন উপস্থিতির প্রকাশ্য সমালোচনা করতে উদ্বুদ্ধ করা। শুরুতে যা ছিল শুধু রাগের বহিঃপ্রকাশ তা খুব তাড়াতাড়ি আন্দোলনে পরিণত হয় এবং এই আন্দোলনের প্রধান নেতা সালমান আল আওদা এবং সাফার আল হাওয়ালি সবার নজরে চলে আসেন। সাহওয়া আন্দোলন কর্তৃক দাবিনামা প্রকাশ এবং “বৈধ অধিকার রক্ষা কমিটি” গঠনের পর সৌদি সরকার সাহওয়া আন্দোলনের নেতা এবং কর্মীদের গ্রেফতার করা শুরু করে।

২০১৭ সালে এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে যখন নতুন ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতা অধিগ্রহণ করে। সে সাহওয়া আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত আলেমদের পুনরায় গ্রেফতার করার মাধ্যমে এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে এবং “মডারেট ইসলামে” ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। (১) সৌদির প্রচারিত এই “মডারেট ইসলাম” হলো এমন একটি ধারণা যেখানে হ্যালোউইন, কনসার্ট, ভোগবাদী উদযাপন সবই বৈধ।

সাহওয়া আন্দোলন কী এবং কেন সৌদি সরকার একে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে তা বুঝতে হলে আগে আমাদের এর উত্থান, এর আদর্শ এবং সৌদির লিবেরালাইজেশন প্রকল্পে তা কী হুমকি তৈরি করে তা জানতে হবে।

মুসলিম ব্রাদারহুড

হাসান আল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯) ১৯২৮ সালে মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন। হাসান আল বান্না ছিলেন রাশিদ রিদার ছাত্র। রাশিদ রিদা, জামাল আল-দিন আল-আফগানি এবং তার ছাত্র মুহাম্মদ আব্দুহ কর্তৃক মিশরে ফ্রি মিশনারির প্রবর্তনের কঠোর বিরোধী ছিলেন। জায়োনিস্ট আন্দোলনের ব্যাপারেও তার একই অবস্থান ছিল। রাশিদ রিদার এইসব পাশ্চাত্যবিরোধী ধারণা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

এই তিনজন এবং বিশেষত মুহাম্মদ আব্দুহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন: মুহাম্মদ আব্দুহ : উনিশ শতকের অন্যতম প্রধান মর্ডানিস্ট রিফরমিস্ট

১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরে মুসলিম ব্রাদারহুড জামাল আব্দুন নাসেরকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়, যা তাদের উপর একের পর এক নির্যাতনের ধারার সূচনা করে। ১৯৬৫ সালে এই আন্দোলন এমন একটি মোড় নেয় যা আন্দোলনের চিত্রকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে দেয়। একদিকে, নাসের মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মীদের জন্য কনসেনট্রেশান ক্যাম্প তৈরি করে। অন্যদিকে, সায়্যিদ কুতুবের চিন্তাধারার বিকাশও এইসময়েই হয়।

হাসান আল বান্নার পদ্ধতি ছিল দাওয়াহের মাধ্যমে সমাজের সংস্কার, এর বিপরীতে কুতুব বিশ্বাস করতেন শরিয়াহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা আছে সেসব আগে নির্মূল করতে হবে:

❝যারা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কর্তৃত্বকে করায়ত্ত করেছে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে নির্যাতন করে যাচ্ছে তারা শুধুমাত্র দাওয়াহের প্রভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিবে না। যদি শুধু দাওয়াহ দিয়ে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করা সম্ভব হতো তাহলে নবিরা সহজেই দ্বীন কায়েম করতে পারতেন।❞(২)

আরব কোল্ড ওয়ার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ডিকলোনিয়ালিজমের বছরগুলোতে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলো মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতা দখল করতে শুরু করে। মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এই সরকারগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে, যার ফলে মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক কর্মী জীবনরক্ষার্থে দেশত্যাগ করে। ১৯৫৪ সালে নাসেরের প্রথম দফা নির্যাতনের পর মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক কর্মী সৌদি আরবে আশ্রয় গ্রহণ করে।

১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকের আগপর্যন্ত মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মীরা সৌদি আরবে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত এবং পশ্চিমাদের মধ্যে ভূরাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে আঞ্চলিক শত্রুতা বাড়তে থাকে। সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ অবলম্বন করে এবং নাসেরের মিশর সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ অবলম্বন করে। এভাবে আরব কোল্ড ওয়ারের সূচনা হয় যেখানে মুসলিম ব্রাদারহুড সৌদির কেন্দ্রীয় খেলোয়াড়ে পরিণত হয়।(৩)

নাসেরের প্যান-আরব সমাজতন্ত্রের বিপরীতে বাদশাহ ফয়সাল ইসলামকে সৌদি আরবের প্রধান আদর্শ হিসাবে ঘোষণা করেন এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সাহায্যে ইসলামিক ভ্রাতৃত্বকে নাসেরের আরব জাতিয়তাবাদের বিকল্প হিসাবে উপস্থাপন করেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ১৯৬১ সালে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় যা পরিচালিত হতো মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মীদের দ্বারা।(৪)

জেদ্দার আবদ্ আল-আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং মক্কায় এর শাখায় (যা ১৯৮১ সালে উম্ম আল-কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়) শুরুর দিকে মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ফ্যাকাল্টি মেম্বারের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ কুতুব, সায়্যিদ কুতুবের ছোট ভাই। মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রসিদ্ধ কর্মী সৌদি আরবে শিক্ষকতায় যোগদান করে এবং সত্তর ও আশির দশকে সেইসব প্রতিষ্ঠানসমূহে তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। এর পাশাপাশি সেকেন্ডারি স্কুলগুলোতেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। (৫)

ষাটের দশকে সৌদি আরব ধর্মীয় ক্ষেত্রে একটি বড়সড় বহিরাগত প্রভাব প্রত্যক্ষ করে যার পিছনে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল। এই পরিবর্তন পরবর্তীতে একটি বিশাল সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দেয় যা তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও নিজস্ব সংগঠনের জন্ম দিয়েছিল এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি সৌদির সামাজিক অঙ্গনের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে পৌঁছে গিয়েছিল।(৬)

সাহওয়া আন্দোলনের উত্থান

আল সাহওয়া আল ইসলামিয়া বা সাহওয়া ছিল একটি সামাজিক আন্দোলন। মতাদর্শের দিক থেকে এটি মূলত মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ এবং মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনের উত্তরাধিকার।

মুসলিম ব্রাদারহুড ছিল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিনা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা। অন্যদিকে মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহের আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাওহীদের প্রচার এবং প্রসার, সেইসাথে বিদায়াত নির্মূল করা, যা সালাফে সালেহিনের কাছে অপরিচিত ছিল এবং যা ইসলামে নতুন করে প্রবেশ করানো হয়েছে।

মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ এবং মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলন ছিল একে অপর থেকে আলাদা এবং এদের প্রধান উদ্দেশ্যেও ছিল একে অপর থেকে ভিন্ন। এই আন্দোলনদ্বয় ছিল একে অপরের পরিপূরক এবং সেইসাথে সাহওয়া আন্দোলনের ভিত্তিমূল। সাহওয়া আন্দোলন গড়ে উঠে সৌদির শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে যেখানে মুসলিম ব্রাদারহুডের চিন্তাধারা পড়ানো হতো। মুসলিম ব্রাদারহুডের সৌদি ধারা মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহের প্রচারিত আকিদা গ্রহণ করে।

সাহওয়া আন্দোলনের রূপকার মুহাম্মদ কুতুব ১৯১৯ সাথে মিশরে জন্মগ্রহণ করেন। উনি উনার বড় ভাই সায়্যিদ কুতুবের ছায়ায় বড় হতে থাকেন। ৬ বছর কারাভোগ এবং ১৯৬৬ সালে বড় ভাইয়ের ফাঁসি প্রত্যক্ষ করার পর ১৯৭১ সালে তিলি সৌদি আরবে স্থানান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এখানে তিনি মক্কায় ফ্যাকাল্টি অফ শারিয়াহ এর প্রফেসর হিসাবে নিযুক্ত হন।

মুহাম্মদ কুতুব সফলভাবে মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ এবং উনার বড় ভাই সায়্যিদ কুতুবের চিন্তাধারাকে সম্মিলিত রূপ দিতে সফল হন। মুহাম্মদ কুতুব সফলভাবে মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ এবং উনার বড় ভাই সায়্যিদ কুতুবের চিন্তাধারাকে সম্মিলিত রূপ দিতে সফল হন। তিনি মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহ কর্তৃক প্রচারিত তাওহিদের ৩ ভিত্তির সাথে আরও একটি ভিত্তি সংযুক্ত করেন যার নামকরণ তিনি করেছিলেন ‘তাওহিদ আল হাকিমিয়াহ‘। যার মূল কথা ছিল সার্বভৌত্ব শুধু আল্লাহর এবং যে শাসক আল্লাহর প্রেরিত বিধান দিয়ে শাসন করে না সে আল্লাহর একত্ববাদকে অমান্য করে।

মুহাম্মদ কুতুবের চিন্তাধারা ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গড়ে উঠে যখন খিলাফাহ বিলুপ্ত হয় এবং ইসলামি রাস্ট্রকে খণ্ডবিখণ্ড করে অনেকগুলো জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত করা হয়। সেইসব জাতিরাস্ট্রে আল্লাহর বিধান প্রণয়ন না করে সেকুলার ঔপনিবেশিকদের রচিত সেকুলার সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।

তাওহীদ ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না শরিয়াহ শাসকের উপর সার্বভৌম হবে” এই ধারণাটি পরবর্তীতে সাহওয়া আন্দোলন এবং সাহওয়া আন্দোলন কর্তৃক সৌদি সরকারের সমালোচনায় প্রধান ভূমিকা পালন করে করে।

সম্পর্কিত : খিলাফাতের যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তা

সংঘাতের সূচনা

মুসলিম ব্রাদারহুডের চিন্তাধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সৌদি যুবকদের মধ্যে একটি জাগরণ ঘটে। তারা সাহওয়া কর্তৃক পরিচালিত ইয়ুথ ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে যেখানে মূলত ইসলামি তারবিয়ায় গুরুত্ব দেয়া হত। এছাড়া মুসলিম পরিচয় এবং সারাবিশ্বের মুসলিম উম্মাহের প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও সেখানে কাজ করা হত। সৌদি যুবকদের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে ধর্ম এবং রাজনীতি দুটি পৃথক সত্তা নয়, বরং ইসলামকে সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করে একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা হিসাবে দেখা উচিত।

ঐতিহ্যগতভাবে, রাজনৈতিক বিষয় সবসময়ই সৌদি রাজপরিবারের হাতে ছিল। কিন্তু নতুন প্রজন্মের বুদ্ধিজীবী, আলেম এবং রাজনৈতিক কর্মী যারা রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রভাবশালীদের প্রভাবে দূরে সরে পড়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকারের প্রতি নতুন দায়িত্ববোধ এবং আস্থা তৈরি হতে শুরু করে।

১৯৯০ সালের ১৩ আগস্ট, বর্ষীয়ান আলেমদের কমিটির কাউন্সিল,হায়া’ত কিবার আল-উলামা একটি বৈঠকের আয়োজন করে যেখান থেকে একটি ফতোয়া জারি করা হয়। উক্ত ফতোয়ায় সৌদি আরবের বিরুদ্ধে আগ্রাসন পরিকল্পনাকারীদের দমনে সশস্ত্র বাহিনীকে নিযুক্ত করার রাস্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানানো হয়।(৭)

সাহওয়াপন্থী আলেমরা উক্ত ফতোয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁরা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকদের দুই পবিত্র মসজিদের ভূমিতে প্রবেশের অনুমতি প্রদানের নিন্দা করেন এবং উক্ত ফতোয়াকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানান।

সাফার আল-হাওয়ালি “উম্মাহের উলামাদের বিভ্রান্তি থেকে মুক্তকরণ” নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন যেখানে তিনি সৌদি আলেমদের ফিকহ আল-ওয়া’ক্বি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা না থাকার সমালোচনা করেন। সাফার আল-হাওয়ালির মতে, আরব আলেমদের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা না থাকা উনাদের এই বিষয়ে ভ্রান্ত পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সালমান আল-আওদা “রাস্ট্রের পতনের কারণ” শিরোনামে একটি লেকচার প্রদান করেন যেখানে তিনি সৌদি রাজনীতির ভিশন, রাষ্ট্রের বৈধতা বজায় রাখতে কী কী করা উচিত না তুলে ধরেন। ইবনে খালদুনের লেখা অবলম্বনে তিনি রাস্ট্রের পতনের ১২ টি কারণ বর্ণনা করেন। এই কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, রাস্ট্রযন্ত্রের নৈতিক ও অর্থনৈতিক অধঃপতন, শাসক কর্তৃক নির্যাতন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে শুরার অনুপস্থিতি। শাসকের প্রতি ইঙ্গিত না করে তিনি বলেন:

❝কিছু রাস্ট্র গড়ে উঠেছে ধর্মের ভিত্তিতে, সেই ধর্মের প্রতিরক্ষা এবং প্রচার-প্রসারের জন্য, সৎ কাজে আদেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধের জন্য এবং শরিয়াহ বাস্তবায়নের জন্য… [like this] যতক্ষণ পর্যন্ত একটি রাস্ট্র (যেমন, সৌদি আরব) তার আদর্শের প্রতি সৎ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা শক্তিশালী, সম্মানিত এবং অপরাজেয় থাকবে কারণ সেই রাস্ট্রের প্রতি তার জনগণের সমর্থন বজায় থাকবে। কিন্তু যদি তা তার আদর্শ থেকে দূরে সরে যায় তাহলে সেটি তার অস্তিত্বের কারণ হারিয়ে ফেলে। এর প্রথমদিককার সমর্থকরা তাদের পরিত্যাগ করে এবং তা নতুন সমর্থন অর্জন করতেও ব্যর্থ হয়, যা তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।❞(৮)

সৌদি সরকার এর প্রতিক্রিয়ায় সাহওয়া আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্র‍্যাকডাউন শুরু করে এবং আল-আওদা এবং আল-হাওয়ালি উভয়কেই গ্রেফতার করে। পরিশেষে, সাহওয়া যেখানে চেয়েছিল সৌদি সরকারকে উপদেশ প্রদান করতে এবং তারা যে পথ অবলম্বন করেছে তা থেকে সাবধান করতে সেখানে সৌদি সরকার তাদের দাবিসমূহকে নিজেদের জন্য হুমকি এবং তাদের রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপস্বরূপ হিসেবে বিবেচনা করে। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো সৌদির রাজনৈতিক ব্যবস্থা নড়েবড়ে হয়ে যায় যা ১৯৩২ সালে এর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্থিতিশীল ছিল।

চিন্তাশীল প্রজন্মের স্থলে ভোগবাদী প্রজন্ম

নতুন ক্রাউন প্রিন্স আসার পর, সৌদি সরকার সাহওয়া আন্দোলনের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন সৌদি সরকার সেকুলার বা ইসলামি এক্টিভিস্ট কাউকেই ছাড় দিতে নারাজ। সৌদি সমাজকে লিবেরালাইজ করার সৌদি সরকারের ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনার সামনে যেই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তাকেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, আল-আওদা, আল-হাওয়ালি, আলি আল-ওমারি, আওয়াদ আল-কারনি এবং আরও অনেকেই যারা ২০১৭ সালের ক্র‍্যাকডাউনের পর পুনরায় গ্রেফতার হয়েছিলেন।

সম্পর্কিত: সৌদির কল্পিত রেখা শহর : প্রযুক্তি কী প্রকৃতিকে প্রতিস্থাপন করতে পারে?

সৌদি আরবে যারা সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল সৌদি সরকার তাদের সবাইকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সত্যিকারের পরিবর্তনের বদলে সৌদি সরকার একটি মেকি পরিবর্তন আনে, যেখানে তরুণদের অন্তহীন বিনোদনে মত্ত হতে প্ররোচিত করা হয় এবং এমন ভাসাভাসা পরিবর্তন আনা হয় যা সৌদি রাজপরিবারের জন্য কোন হুমকি তৈরি করতে পারে না। স্বাধীন এবং শক্তিশালী ইসলামি চিন্তাবিদ দ্বারা সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর বদলে তারা সরকারের প্রতি অনুগত সেই সাথে নেটফ্লিক্স, রোলার কোস্টার, রক কন্সার্টে মত্ত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলছে।

বিরোধীরা খাশোগি হত্যাকাণ্ড এবং সৌদির লিবেরালাইজেশন প্রকল্পের বিরোধিতাকারী আলেমদের গ্রেফতার হতে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছে। এই পদক্ষেপসমূহ দ্বারা সৌদি সরকার এটি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে যে ভিন্নমত একদমই সহ্য করা হবে না।

ইসলামি পুনঃজাগরনের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটলেও এর চেতনার পরিসমাপ্তি ঘটেনি। এই চেতনার মূলমন্ত্র হলো সমাজের প্রত্যেকটি স্তরে ইসলামের উপস্থিতি রয়েছে, ইসলাম শুধু ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রীতি-রেওয়াজের সমষ্টি না বরং একটি পরিপূর্ণ জীবন-বিধান। বর্তমানে আমরা একটি সত্যিকারের ইসলামি সমাজের জন্য অপেক্ষা করছি যেখানে শরিয়াহ হবে শাসকের উপর কর্তৃত্বশীল। এটি এমন কিছু না যা অর্জন করা সম্ভব না, খুলাফায়ে রাশেদার সময় আমরা তা একবার অর্জন করেছিলাম এবং ইন শা আল্লাহ আমরা তা আবারও অর্জন করব।

সম্পর্কিত : ইসলামে খিলাফাতের ধারণা

তথ্যসূত্র

(১) https://www.theguardian.com/world/2017/oct/24/i-will-return-saudi-arabia-moderate-islam-crown-prince

(২) সায়্যিদ কুতুব, মা’আলিম ফিল তারিখ (মাইলস্টোন), পৃষ্ঠা ৬৮.

(৩) লাক্রোয়িক্স, স্টিফেন ইসলামের পুনঃজাগরন, হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১১, পৃষ্ঠা ৪০.

(৪) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪২.

(৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৪-৪৫

(৬) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫১.

(৭) চার্লস কুর্জমান, মধ্যপ্রাচ্যের পলিসিসমূহে ইউএসপন্থী ফতোয়া, ভলিউম ১০, নং ৩, বসন্ত ২০০৩, পৃষ্ঠা ১৫৭.

(৮) সালমান আল-আওদা, “আওসাব সুকুত আল-দুয়াল”, রেকর্ডকৃত বক্তৃতা, ২৮ আগস্ট, ১৯৯০.

MuslimSkeptic Needs Your Support!
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments